ইব্রাহিম (আ.) থেকে মক্কা পর্যন্ত: হজের পবিত্র ধারা

ইসলামের পবিত্রতম ভূমি হলো মক্কা যা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এরও জন্মস্থান। এখানেই আছে পবিত্র কাবাঘর যা সারাবিশ্বের মুসলমানদের কিবলা যেদিক বরাবর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়। এই কাবাকে প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলমান আবর্তন বা তাওয়াফ করছে। আর প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে পাঁচদিনের জন্য সারা দুনিয়া থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় মক্কা নগরে হজ পালনের জন্য।

হজ ও হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সম্পর্ক

পবিত্র হজ ও হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর স্মৃতিবাহী ঘটনা পরস্পর সম্পৃক্ত। পবিত্র কুরআনে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর নাম ২৫টি সুরায় ৬৯ বার উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার পুত্র ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র কাবাঘর পুনর্র্নিমাণ করেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায় “স্মরণ করো যখন হজরত ইব্রাহিম ও হজরত ইসমাইল (আ.) কাবার ভিতগুলো ওঠাচ্ছিল” (সুরা বাকারা : আয়াত : ১২৭)। হজরত ইব্রাহিম (আ.) মানবজাতির জন্য বায়তুল্লাহে পবিত্র হজের প্রচলন করেন।

কুরআনে হজের আদেশ

পবিত্র হজ ও ইব্রাহিম (আ.) প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন “স্মরণ করো যখন আমি ইব্রাহিমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহ) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দাও ; তারা আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূও পথ পাড়ি দিয়ে এবং প্রাচীন ঘরের (বায়তুল্লাহ) তাওয়াফ করে” (সুরা হজ : আয়াত : ২৬-২৯)।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া

হজরত ইব্রাহিম (আ.) মুসলিম জাতির সুখ লাভ, দুঃখ লাঘবে, খাদ্যবস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা, সন্তান-সন্তানাতি ইত্যাদির জন্য অসংখ্যবার দোয়া করেছিলেন। দোয়াগুলোর উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন সুরায় যেমন:

রিজিক ও আবাসন:

“রাব্বিজ জাআল হাজাল বালাদান আমিনাও ওয়ারযুক্ব্ আহলাহু মিনাছামারাত” অর্থাত্-হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে নিরাপদ শহর করিও আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান আনে তাহাদেরকে ফলমূল হইতে জীবিকা প্রদান করিও (সুরা বাকারা : আয়াত : ১২৬)।

নামাজ প্রতিষ্ঠা ও বংশধরদের কল্যাণ:

“রাব্বিজজ আলনি মুক্বিমাস সালাতি ওয়া মিন জুররিইয়্যাতি রাব্বানা ওয়া তাক্বাব্বাল দুআয়ি। রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালে দাইয়্যা ওয়ালিল মুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াক্বুমুল হিসাব।” অর্থাত্-হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ও আমার বংশধরদের নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও হে আমাদের প্রতিপালক! আমার দোয়া কবুল করো। হে আমার প্রতিপালক! যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে আমার পিতামাতাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করো (সুরা ইব্রাহিম : আয়াত : ৪০-৪১)।

কাবাঘর নির্মাণ ও সংস্কার

মহানবী (সা.) বলেন আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহতাআলা জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে তাঁদের কাবাগৃহ নির্মাণের আদেশ দেন। এ গৃহ নির্মিত হয়ে গেলে তাঁদের তা তাওয়াফ করার আদেশ দেওয়া হয় এবং বলা হয় আপনি সর্বপ্রথম মানব এবং এ গৃহ সর্বপ্রথম গৃহ যা মানবমনলীর জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে।

কোনো কোনো বর্ণনা মতে আদম (আ.) ও আসমান জমিন সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে ফেরেশতা কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হয়। কেউ কেউ বলেন আসমান জমিন সৃষ্টির ৪০ বছর আগে ফেরেশতা কর্তৃক পৃথিবীর মাঝখানে কাবাঘর নির্মিত হয়েছে।

হজের ঘোষক হজরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম

নবী-রাসুলদের মধ্যে ইবরাহিম (আ.) অন্যতম। তাঁকে বলা হয় আবুল আম্বিয়া তথা নবীদের আদি পিতা। সাতজন নবী ছাড়া সব নবী রাসুল তাঁর বংশ থেকে এসেছেন। তিনি মুসলমানদের জাতির পিতা। মুসলিম নামটি তিনি প্রথম রাখেন।

আল্লাহতাআলা তাঁর প্রশংসায় বলেছেন “নিশ্চয়ই ইবরাহিম ছিলেন সব গুণের সমাবেশকারী সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর অনুগত এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। আল্লাহ তাঁকে মনোনীত করেছিলেন এবং পরিচালিত করেছিলেন সরল পথে।” (সুরা : নাহল : আয়াত : ১২০-১২১)

ইমাম বগভি বলেন কাবাঘর নির্মাণ করার পর আল্লাহতাআলা আদম (আ.) কে নির্দেশ দেন যে মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে বায়তুল্লাহর হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন ইবরাহিম (আ.) এর ঘোষণার উত্তরই হচ্ছে হজে লাব্বাইক বলার আসল ভিত্তি। ইবরাহিম (আ.) এর ঘোষণাকে সব মানবমনলী পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে কিয়ামত পর্যন্ত হজের ধারা কায়েম থাকবে।

হজ ফরজ হওয়ার শর্ত

হজ আর্থিক ও দৈহিক ইবাদত। ফলে হজের জন্য আর্থিক ও দৈহিক উভয় দিক দিয়ে সামর্থ্যবান হওয়া আবশ্যক। হজ ফরজ হওয়ার শর্ত সাতটি:

  1. মুসলিম হওয়া
  2. জ্ঞানবান হওয়া
  3. সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া
  4. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
  5. আজাদ হওয়া
  6. আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া
  7. হজের সময় হওয়া

হজের ফজিলত

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে হজের নানাবিধ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

উত্তম ইবাদত:

আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে কোন কাজটি সর্বোত্তম? তিনি বলেন: “আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান।” তারপর জিজ্ঞেস করা হলো: “এরপর?” তিনি বলেন “আল্লাহর পথে জিহাদ।” আবার জিজ্ঞেস করা হলো: “তারপর?” তিনি বলেন: “কবুল হওয়ার যোগ্য হজ।”

কবুল হওয়ার যোগ্য হজ (হজে মাবরুর) হচ্ছে যে হজের সঙ্গে কোনো পাপ মিশ্রিত হয় না। হাসান বলেছেন: হজে মাবরুর হচ্ছে সেই হজ যা থেকে ফিরে আসার পর মানুষ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত এবং আখিরাতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। একটি বর্ণনায় এসেছে যে হজে মাবরুর হচ্ছে যে হজে মানুষকে খাদ্য খাওয়ানো হয় এবং বিনম্র ভাষায় কথা বলা হয়।

হজ জিহাদতুল্য:

হজকে জিহাদের সমতুল্য আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন—হাসান বিন আলী (রা.) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এলো। সে বলল “আমি ভীরু ও দুর্বল।” রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন “এমন জিহাদে চলে এসো যাতে কোনো অস্ত্রের তীক্ষতা নেই। তা হলো হজ।”

নারীদের জিহাদ হলো হজ:

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “দুর্বল, বৃদ্ধ ও মহিলাদের উপযোগী জিহাদ হচ্ছে হজ।”

আয়েশা (রা.) বলেন “হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনি তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করেন। তাহলে আমরা মহিলারা জিহাদ করি না কেন?” তিনি বলেন, “তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো হজে মাবরুর।”

আয়েশা (রা.) বলেন “হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমরা কি আপনাদের সঙ্গে জিহাদ ও লড়াই করতে পারি না?” তিনি বলেন “তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম জিহাদ হলো হজে মাবরুর।” আয়েশা (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছ থেকে এ কথা শোনার পর আমি আর হজ বাদ দিইনি।

হজ গুনাহ মুছে দেয়:

আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “যে ব্যক্তি হজ করল কোনো অশ্লীল কাজ বা গুনাহর কাজ করল না সে যখন বাড়িতে ফিরবে তখন সদ্যঃপ্রসূত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরবে।”

আমর ইবনুল আস বলেন “যখন আল্লাহ আমার অন্তরে ইসলাম ঢোকালেন তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে উপস্থিত হলাম। তাঁকে বললাম আপনার হাত এগিয়ে দিন আমি আপনার কাছে বাইয়াত হব। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। তিনি বলেন তোমার কী হলো আমর? আমি বললাম আমার অতীতের গুনাহ মাফ করা হোক। তিনি বলেন তুমি কী জানো না ইসলাম তার আগেকার সব কিছু মুছে দেয়? হিজরতও তার আগেকার সব কিছু মুছে দেয়। হজও তার আগের সব কিছু মুছে দেয়।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সا.) বলেছেন “তোমরা হজ ও ওমরাহ একাদিক্রমে করো। এই দুটি সব গুনাহ মাফ করে দেয় যেমন কামারের হাপর লোহা স্বর্ণ ও রুপার মরিচা দূর করে দেয়। হজে মাবরুরের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।”

হাজিরা আল্লাহর মেহমান:

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “হাজিরা ও ওমরাহকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি ও মেহমান। তারা কোনো দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন আর মাফ চাইলে মাফ করে দেন।”

হজের সওয়াব জান্নাত:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “এক ওমরাহ অন্য ওমরাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সব গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়। আর হজে মাবরুরের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।”

জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “এই ঘর কাবা ইসলামের খুঁটি। যে ব্যক্তি এই ঘরের উদ্দেশে হজ বা ওমরাহ করতে বের হবে সে আল্লাহর বিশেষ নিরাপত্তায় থাকবে। আল্লাহ যদি তাকে এই অবস্থায় মৃত্যু দেন তাহলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যদি তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠান তাহলে প্রচুর সওয়াব গণিমতসহ ফেরত পাঠাবেন।”

হজ না করার ফল

সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ করেনি সে একটি ফরজকাজ বর্জন করল। এর ফলে সে মহাপাপী হবে। মহানবী (সা.) বলেন “অনিবার্য প্রয়োজন অথবা অত্যাচারী শাসক কিংবা কঠিন রোগ যদি কাউকে হজ পালনে বিরত না রাখে আর সে হজ পালন না করে মারা যায় তবে যেন ইহুদি-নাসারার মতোই তার মৃত্যু হলো।”

মক্কা নগরবাসীর জন্য হজরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম দোয়া

মক্কা নগরীর অধিবাসীদের জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যের জন্য আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.) দোয়া করে বলেছিলেন “হে আমার প্রতিপালক! একে আপনি নিরাপদ নগরী করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা দান করুন।” (সুরা : বাকারা : আয়াত : ১২৬)।

মক্কা পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম নগরী। এই নগরীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। কোরআনের একাধিক আয়াতে পবিত্র নগরীর বর্ণনা এসেছে। এসব আয়াতে এই নগরীর সম্মান, মর্যাদা, প্রাচীনত্ব ও গুরুত্ব ফুটে ওঠে।

আল্লাহ যেন আমাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও তার ঘর জিয়ারত করার তৌফিক দান করেন এবং সবাইকে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাসময়ে হজ পালন করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm