পতেঙ্গার রক্তাক্ত রাতে টার্গেট ছিলেন শুধু আকবর, গুলির পর তরুণী চড়ে বসল হামলাকারীদের বাইকে!
সাজ্জাদ-সরোয়ারের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে নতুন মোড়
সন্ধ্যার হালকা হাওয়া আর সৈকতের কোলাহল—চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিচে ছিল মনোরম পরিবেশ। ঠিক তখনই ২৮ নম্বর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন ঢাকাইয়া আকবর, এক তরুণী ও চার যুবক। খাবারের অর্ডার নেওয়ার আগেই আচমকা চারজন অস্ত্রধারী যুবক মোটরসাইকেলে করে এসে গুলি চালায় আকবরকে লক্ষ্য করে। আকবর প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ানোর চেষ্টা করলেও গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে থাকা চার যুবক মুহূর্তেই পালিয়ে যায়, আর তরুণীটি সবাইকে চমকে দিয়ে হামলাকারীদের মোটরসাইকেলে উঠে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হামলার মুহূর্ত ছিল যেন সিনেমার দৃশ্য।
সন্ত্রাসের রক্তাক্ত রাত
চট্টগ্রামের আলোচিত ‘সন্ত্রাসী’ আলী আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবর (৪৪) আরেকদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও দুজন পথচারী—একজন ৮ বছরের শিশু, অপরজন এক যুবক। আহতরা সবাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সৈকতে প্রকাশ্যে গুলির তাণ্ডব
শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত আকবরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে অপারেশন থিয়েটারে তার চিকিৎসা চলছে।
একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জান্নাতুল বাকী (৩০)। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর মৃত বুলু মিয়ার ছেলে। ঘটনার সময় তিনি পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশের বরাতে জানা গেছে, তিনি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে কর্মরত। বর্তমানে তিনি চমেক হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
নিরীহ পথচারী ও শিশুও রেহাই পেল না
আহত অপর শিশু মহিম ইসলাম রাতুলের (৮) বাড়ি দক্ষিণ পতেঙ্গার ফুলছুরিপাড়ায়। সে শওকত হোসেনের ছেলে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাতুলকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ৮৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন।
আহতদের স্বজন কুসুম ও শফি জানান, তাদের জানা মতে পতেঙ্গা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘সারোয়ার গ্রুপ’ ও ‘সাজ্জাদ গ্রুপ’-এর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে পথচারী হিসেবে রাতুল ও বাকী গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সাজ্জাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
হাসপাতালে আসা স্বজনদের দাবি, এই ঘটনায় কারাগারে বন্দী ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেনের অনুসারীরা জড়িত। এর আগে গত ২৯ মার্চ ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি করলে দুজন মারা যান নগরের বাকলিয়া এলাকায়।
আকবরের বিরুদ্ধে হত্যা-অস্ত্রসহ ১০ মামলা
আকবর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার মঞ্জু মিয়ার ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে। ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত আকবর ও সরোয়ার।
সোশ্যাল মিডিয়া ও ভিডিও ফুটেজে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত
কারাগারে আটক ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেনের অনুসারী ও তাঁর স্ত্রী তামান্না শারমিনকে নিয়ে কটূক্তি করে নিজের ফেসবুক আইডিতে প্রায়ই ভিডিও দিতেন আকবর। পাশাপাশি সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্নাও আকবরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে নানা ভিডিও দিতেন। ঘটনার জের এসব ভিডিও থেকে বলেও ধারণা অনেকের।
আকবরের নিজের মুখেই হামলাকারীদের নাম
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় রাত আটটার দিকে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন আকবর। ওই সময় হঠাৎ ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে আকবরকে লক্ষ্য করে। গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অস্ত্রধারীরা চলে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ আকবরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ঘটনার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আহত আকবর কাঁদতে কাঁদতে নিজেই বলতে থাকেন, তাকে গুলি করেছে রায়হান, খোরশেদ, ইমন, বোরহান। তিনি আরও বলেন, মেয়েটার সঙ্গে আজকেই তার প্রথম দেখা, এর আগে কখনো দেখা হয়নি। তাকে যেন দ্রুত মেডিকেলে নেওয়া হয়।
আহত অবস্থায় আকবরের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, যা ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়। চমেক হাসপাতালের পুলিশ সদস্যরা জানান, তার শরীরে সাতটি গুলির আঘাত রয়েছে। পা, বুকে, হাতে ও পেটে গুলি লেগেছে। এছাড়াও আহত শিশু রাতুলের ডান হাতে এবং বাকীর পায়ে গুলির ক্ষত রয়েছে।
অস্ত্র ছিল ভয়ঙ্কর, লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট
পতেঙ্গা সৈকতে ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়রা ৭টি গুলির খোসা সংগ্রহ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা এসব খোসা দেখে বলেন, এগুলো সম্ভবত ৯ মিমি পিস্তলের গুলির খোসা। ছোট এবং সিলিন্ডার আকৃতির রিমলেস এই কার্তুজ সাধারণত আধুনিক হ্যান্ডগানে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে Browning, Glock, Beretta ও সাবমেশিনগান Uzi, MP5-এ ব্যবহৃত 9×19mm Parabellum গুলি এটি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তরুণী চলে যান হামলাকারীদের মোটরসাইকেলে
পতেঙ্গা বিচের এক ব্যবসায়ী জানান, ঢাকাইয়া আকবর, একজন নারী ও আরও চারজন যুবক—মোট ছয়জন—২৮ নম্বর দোকানে বসেছিলেন। খাবারের অর্ডার নেওয়ার আগেই চারজন যুবক মোটরসাইকেলে করে এসে একজন আকবরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আকবর পালানোর চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হন। তার সঙ্গে থাকা চার যুবক দৌঁড়ে পালিয়ে যায়, আর ওই তরুণী গুলিবর্ষণকারীদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে উঠে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
সূত্রে জানা গেছে, সেই তরুণীর নাম নুসরাত জাহান। তিনি নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে পতেঙ্গা সৈকতে যান।
আকবর আহত হয়েও প্রায় ৪০০ ফুট দূরে একটি অন্ধকার কোণে গিয়ে লুটিয়ে পড়েন। তার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা গিয়ে উদ্ধার করেন। তবে অনেকে দাবি করেছেন, আকবরের হাতেও একটি অস্ত্র ছিল, কিন্তু পুলিশ সেটির অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি।
পূর্বপরিকল্পিত টার্গেট হামলা
সিএমপি বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সোহেল পারভেজ বলেন, এই হামলা পরিকল্পিত। আকবরের শরীরে একাধিক গুলি লেগেছে। হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। পুলিশের ধারণা, এটি সন্ত্রাসী চক্রেরই কাজ।
সাজ্জাদ-সরোয়ার বিরোধের রক্তাক্ত পরিণতি
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এটিকে ‘টার্গেট হামলা’-এর ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পুরনো অপরাধী গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মল থেকে গ্রেপ্তার হন সন্ত্রাসী সাজ্জাদ। এরপর ২৯ মার্চ নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোডে একটি প্রাইভেট কারকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে দুজন নিহত হন। তবে সেই হামলায় টার্গেট সরোয়ার হোসেন বেঁচে যান।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার এক আসামি আদালতে জবানবন্দিতে জানান, এলাকার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়া সহ মোট পাঁচটি কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা সরোয়ারকে হত্যা করতে চেয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে, সাজ্জাদ কারাগারে থাকলেও তার অধিকাংশ অনুসারী এখনও ধরা পড়েনি।
শহরে অপরাধচক্র আবারও সক্রিয়, আতঙ্কে জনজীবন
একটি ছুটির দিনে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পতেঙ্গায় এমন প্রকাশ্য সশস্ত্র হামলা নগরবাসীকে হতবাক করেছে। স্থানীয়রা বলছেন, সৈকতে পর্যাপ্ত পুলিশি টহল না থাকায় সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে এমন হামলা চালানোর সুযোগ পেয়েছে। এ ঘটনায় চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জেজে/সিপি