চট্টগ্রামে রাতের টার্গেট ব্যাটারি রিকশা, ছিনতাইয়ে বাধা এলে খুনেও দ্বিধা নেই
ছিনতাইয়ের রিকশা বিক্রি হয় আকার পাল্টে
জীবিকার তাগিদে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে রাস্তায় নামে অঞ্জন ধর। নিয়মিত ভাড়ার আয় দিয়ে ভালোই দিন যাচ্ছিল তার। এর মধ্যে একদিন দু’জন যাত্রী অঞ্জনের গাড়ি ভাড়া করে। গন্তব্যে পৌঁছালে সেখানে আগে থেকেই ওঁত পেতে থাকা আরও দু’জন এসে অঞ্জনের মাথায় ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে অটোরিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। ছিনতাইকারীদের আঘাতের পর নিহত হন অঞ্জন ধর।
ঘটনাটি গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর চান্দগাঁও বণিক পাড়া এলাকার। ঘটনার ১৭ দিন পর জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
শুধু অঞ্জন ধর নন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে নগরজুড়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। এভাবে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় অটোরিকশা ছিনতাইকারী চক্রের হাতে অনেকে হতাহতের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইকারীরা আগে থেকেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা টার্গেট করে। ছিনতাইয়ের পর গাড়িগুলো তারা বিভিন্ন জনের কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করে থাকে।
গত ৭ নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে নগরীর দেওয়ান হাট থেকে পাহাড়তলী যাওয়ার কথা বলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠে চার যুবক। রিকশাটি গলির ভেতর আসতেই চালককে ছুরিকাঘাত করে অটোরিকশাটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় ছিনতাই চক্রের সদস্যরা।
এর মধ্যে সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রাতে। বাবুল নামে এক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের মুখে স্কচটেপ মোড়ানো, হাত-পা বাঁধা মেরে ফেলে ছিনতাইকারীরা। পরদিন ১২ জানুয়ারি সকালে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত বাবুলের স্ত্রী সাবিনা বেগম ওই সময় জানান, ১১ জানুয়ারি রাত ১২টার দিকে নিজের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন বাবুল। সারারাত আর বাড়ি ফিরেননি। সকালে রাস্তায় তার নিথর দেহ পাওয়া যায়। তবে পাওয়া যায়নি অটোরিকশাটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনে নগরীর বিভিন্ন সড়কে এসব অটোরিকশাকে পুলিশি নজরদারিতে পড়তে হয়, ফলে তারা রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রিকশা চালায়। তাই ছিনতাইচক্রের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয় এসব বাহন। যাত্রী সেজে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে গিয়ে অটোরিকশা ছিনতাই করা হয়। এসময় বাধা দিলে চালককে মারধর বা ছুরিকাঘাত, এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করে না ছিনতাইচক্রের সদস্যরা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অনিবন্ধিত হওয়ায় ছিনতাইয়ের পর গাড়ির গঠন বদলালে তারা ধরা পড়ে না। এসব রিকশায় প্রায় অর্ধ লাখ টাকা দামের ব্যাটারি ও সরঞ্জাম থাকে।
আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে ছিনতাই করা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ক্রয়-বিক্রয়ের রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। ছিনতাই চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের পর ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা দামে আরেক চক্রের কাছে এসব অটোরিকশা বিক্রি করে দেন। পরে দ্বিতীয় চক্রের সদস্যরা এসব অটোরিকশার গঠনে কিছুটা বদল ঘটিয়ে সাধারণ অটোরিকশা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেন। এই প্রক্রিয়ার ফলে ছিনতাইয়ের শিকার এসব অটোরিকশা শনাক্ত করাও দুষ্কর হয়ে যায়। ব্যাটারিচালিত এসব অটোরিকশা অনিবন্ধিত হওয়ায় ছিনতাইয়ের পর ভুক্তভোগীর অনেকেই আইনি পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হন না।
একাধিক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। যাত্রী বেশে উঠে পরিকল্পিত স্পটে নিয়ে গিয়ে অটোরিকশার পাশাপাশি দিনের আয় করা সব টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। অবৈধ গাড়ি চালান বলে আইনি প্রতিকারও চাইতে পারেন না অনেক সময়। নিবন্ধনের মাধ্যমে সড়কে মুক্তভাবে চলাচলের দাবি জানান তারা।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক মো. ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনিবন্ধিত গাড়ি চালাই, তাই নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। টাকা দিয়েই লাইনে থাকি। আবার লাইনের বাইরে গেলেও টাকা দেওয়া লাগে। দিনে চালাতে অসুবিধা। ট্রাফিক পুলিশ ধরলেই কথা ছাড়া আড়াই-তিন হাজার টাকা গুনে দেওয়া লাগে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতে রিকশা নিয়ে বের হয়। অনেকেই রাতে ছিনতাইকারী কবলে পড়েছে। কয়েকজন তো অটোরিকশার পাশাপাশি প্রাণও হারালো।’
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক মো. মিলন মিয়া এক্ষেত্রে অনেকটাই সতর্ক। তিনি বলেন, ‘চার বছর ধরে লাইনে আছি। আগে মাঝে মধ্যে রাতে লাইন থেকে বের হয়ে অন্যান্য রাস্তায় যেতাম। কিন্তু এখন আর লাইনের বাইরে যাই না। কারণ, যাত্রী সেজে ছিনতাইকারীরা রিকশায় ওঠে, তারপর একটু অন্ধকার স্থানে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন মিলে রিকশাটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সঙ্গে চালকের টাকাপয়সা, মোবাইলও নিয়ে নেয়। এমনকি মারধরও করে। এরকম পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে ঘটেছে। তাই এখন রাতে সাবধানে গাড়ি চালাই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মাহমুদা পারভীন বেগম, ছিনতাইয়ের ঘটনার কোনো অভিযোগ পেলে ছিনতাই চক্র শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে কী পরিমাণে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে—সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
ডিজে