বিয়ের টোপ ফেলে দুই মাস ধরে ধর্ষণ, অভিযোগের নিশানায় রেল কর্তা

ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ, ফাইভ স্টার হোটেলে রাতযাপন

বাংলাদেশ রেলওয়ের এক উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অবাধ মেলামেশা ও ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছেন এক নারী। ইউটিউবে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় তিনি এ অভিযোগ করেন। বিয়ে না করলে রেল ভবনের সামনে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন ওই নারী।

ধর্ষণের প্রথম ঘটনা রাজশাহীর ‘ওয়ে হোম’ হোটেলে।
ধর্ষণের প্রথম ঘটনা রাজশাহীর ‘ওয়ে হোম’ হোটেলে।

শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ৪০ মিনিটের এক ভিডিওবার্তায় এ অভিযোগ তুলেছেন শিরীন আক্তার নামে ভুক্তভোগী ওই নারী। এর আগে এ ঘটনায় রেল উপদেষ্টা বরাবরে একটি অভিযোগও দেন তিনি।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত রেল কর্মকর্তার নাম মো. আনসার আলী ঢাকা রেলভবনে উপ-পরিচালক (টিসি) হিসেবে কর্মরত আছেন। অন্যদিকে ৩১ বছর বয়সী শিরীন আক্তার রেলওয়ের একটি দপ্তরে অস্থায়ী কর্মচারী (টিএলআর) হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাসিন্দা।

এদিকে অভিযোগ তদন্তে রেলের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি শুনানির পর এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানা গেছে।

ভিডিওবার্তায় যা বললেন শিরীন

ভিডিও জবানবন্দিতে শিরীন বলেন, ‘হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আমার আনসার আলীর সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ হয়। আমিও জানতাম না তিনি একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা, তিনিও জানতেন না আমি রেলওয়ে অস্থায়ী কর্মচারী। এরপর তার সঙ্গে হাই-হ্যালো হলো। পরিচয় হওয়ার পরে আমি তাকে জানাই, তখন আমি জানতে পারলাম যে, তিনি রেলের কর্মকর্তা। তখন আমি তাকে স্যার বলে সম্বোধন করি। যখন তিনি জানতে পারলেন যে আমি তার দেশের লোক, এরপর দুজনই খুশি হলাম। বিভিন্ন সময় আমাদের চ্যাটিং হতো। তখন আমি তাকে এক পর্যায়ে জানাই, আমার একটি কন্যা সন্তান আছে, আমার সিচুয়েশন এই, আমি অনেক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি। এরপর তিনি আমাকে আশ্বাস দেন, আমি আপনাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবো। উনার কথায় ভরসা পাই। এরপর উনার সঙ্গে আমার টাকার কন্ট্রাক্ট হয়, উনাকে আমি বললাম আমার এত টাকা আছে। উনি বললেন, ঠিক আছে। আমি বললাম, টাকার এমাউন্ট যদি বেশিও লাগে তাহলেও আমি রাজি আছি।

শিরীন বলেন, ‘উনাকে আমি বললাম, অনেকগুলো সার্কুলারে আমি আবেদন করেছি। এরপর উনি বললো, ফেসবুক তো সেইফ না, হ্যাক হয়ে যায়। উনি এরপর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেয়। আমি চাকরির বিষয়ে যতটুকু কথা বলার ততটুকু বলেছি। কিন্তু তিনি সকাল ৯টা থেকে ফোন দিতেন এবং বিকাল ৩টার দিকে আমাকে ফোন। এরপর আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আমি কিন্তু তাকে জাস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে রেখেছিলেন। কারণ তিনিও জানিয়েছেন তার স্ত্রী আছে, আমিও জানিয়েছিলাম আমার একটা আট বছরের সন্তান আছে। এভাবে কথা বলতে বলতে, আমাদের মধ্যে একটা বন্ডিং সৃষ্টি হয়েছে। এরপর একদিন উনি বললেন, তার স্ত্রীর অনেক সমস্যা। ফিজিক্যাল অনেক প্রবলেম। তিনি সেটিসফাইড না ওয়াইফের কাছে।’

‘বিয়ে কখন করবেন?’

শিরীন আক্তার বলেন, আপনি তো আমাকে ফোনে দেখেছেন, ফেসবুকে দেখেছেন। আমি মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে। উনি আমাকে অনেক রিকুয়েস্ট করে দেখা করার জন্য। এরপর ঢাকা যাওয়ার কথা বলে আমি উনার সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমি পৌঁছে যায় রাজশাহী, উনি পৌঁছান পরে। তখন শীতকাল ছিল, তারিখ ছিল ১২/১২/২০২৪। দেখা করার পর তিনি বলেন, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই। এরপর উনার সঙ্গে কথা বলে আমি চলে আসতে চাইলে তিনি বলেন, তোমাকে আমার একটু জানার দরকার আছে, তুমি কি আমাকে ট্রাস্ট করো না? তুমি আমার সঙ্গে ওয়ে হোম হোটেলে চলো। এখানে মানুষ আমাকে চিনে ফেলবে। এরপর তিনি আমাকে ফুঁসলিয়ে হোটেলে নিয়ে যান। তিনি আমাকে বলেন, হোটেলে তুমি একটা বেডে থাকবে, আমি একটা বেডে থাকবে। তখন আমি উনার সঙ্গে হোটেলে যাই।’

তিনি বলেন, হোটেলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এর দুই-তিন ঘণ্টা পরে উনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন ওনার সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি হয়। তখন উনাকে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? উনি বলেন, তোমাকে দেখে আমি পাগল হয়ে গেছি। এরপর তিনি আমাকে জোর করে ধর্ষণ করেন। এ কথা রেলওয়ের অনেকেরই জানা আছে। এরপর উনি চলে যান ঢাকা আর আমি চলে আসি বাসায়। উনাকে পরে জিজ্ঞেস করেছি, বিয়ে কখন করবেন? উনি বলেন, টেনশন করো না, তোমার সঙ্গে আমি আজীবন থাকবো।

ফাইভস্টার হোটেলে রাতযাপন

শিরীন বলেন, আমার বাসায় এসে তিনি রাত্রিযাপন করেন। তিনি বলেন, এসএ কর্পোরেশনের (রেলওয়ের আউটসোর্সিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) শাহ আলম নামে একজন ব্যক্তি আছেন তার সঙ্গে উনার খুব ভালো সম্পর্ক। (গত বছরের ২৫ জুন সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে শাহ আলমের মালিকানাধীন খাবার সরবরাহকারী এসএ করপোরেশনের চার কর্মী এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় পরে পুলিশ অভিযুক্ত এসএ করপোরেশনের চার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।) সেখানে একটা জবের কথা বলেন যে, কম্পিউটার বিষয়ে তোমাকে জব দেবো। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি তিনি আমাকে চিটাগংয়ে রাখে। বলেন যে, আমার দুই জন ফ্রেন্ড আছে, তারা বিয়ের সাক্ষী হিসেবে থাকবে। আমি চট্টগ্রামের একটি ফাইভস্টার হোটেলে রাতযাপন করি। এ সময়ও তিনি আমাকে জোর করে ধর্ষণ করেন। পরদিন ভোরে তার দুই ফ্রেন্ড মিজান ও জাকিরের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। তাদের সঙ্গেও খারাপ মেয়ে ছিল।

শিরীন বলেন, ‘আমাকে বিয়ে করার কথা থাকলেও তিনি ঢাকা চলে যায়। আমিও সৈয়দপুর চলে আসি। তখন আমি বুঝতে পারি প্রতারিত হয়েছি। এরপর আনসার আলী আমাকে ফেসবুকসহ সবকিছুতে ব্লক করে দেন। পরে আমি নিরুপায় হয়ে রেলওয়ে উপদেষ্টা ও সচিব মহোদয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার সমস্যার কথা জানালে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি ৫ কর্মদিবসে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি। আমাকে একজন কল করে আবারও জবানবন্দি দিতে বলেন। এরমধ্যে আমাকে একজন কল করে আনসার আলীর সঙ্গে মিটমাট করার প্রস্তাব দেন। রেলভবনের জাকির নামে একজন আমাকে কল করে বলেন, আনসার আলী খুব প্রভাবশালী। তিনি তোমাকে বিয়ে করবে না। তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্ক করো। এরপর আনসার আলীসহ একাধিক ব্যক্তি কল করে টাকায় মিটমাট করতে বলেন। নইলে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেন। এবং আমাদের ঘরে প্রতিদিন লোক পাঠিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব ও হুমকি দিতে থাকেন। আমি দেশবাসীর কাছে এর বিচার চাই।’

‘বিয়ে না করলে আত্মহত্যা করবো’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিরীন আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ভিডিওতে সবকিছু তুলে ধরেছি। ভিডিও প্রচারের পর জাহিদ নামে আনসার আলীর খালাতো ভাই পরিচয়ে একজন আগামীকাল (রোববার) বসে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে। আমি বলেছি, যদি বিয়ের করার জন্য রাজি হয়, তাহলে বসব। অন্যথায় কোনো বৈঠক হবে না। আনসার আলী আমাকে বিয়ে না করলে রেলওয়ে ভবনে সবার সামনে আত্মহত্যা করবো।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে রেল ভবনে উপ-পরিচালক (টিসি) মো. আনসার আলীকে একাধিকবার ফোন করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm