চট্টগ্রাম নগরীর খোলা খাল ও নালাগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। এসব খাল ও নালায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। নগরীর প্রায় খালের পাড় একেবারে অরক্ষিত, নেই কোনো ধরনের রেলিং। প্রায় নালায় স্ল্যাব থাকে ভাঙা, আবার কোনো কোনো জায়গায় একেবারে থাকেই না। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হলে সড়ক কোথায় আর খাল-নালা কোথায়, তা বোঝার উপায় থাকে না। ফলে গত চার বছরে খাল ও নালায় পড়ে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে ১৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৫৭টি খাল আছে চট্টগ্রাম নগরীতে। আর নালা আছে ৯৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬টি খাল সিডিএ’র আওতায় রয়েছে, অপর ২১টির দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সিডিএর আওতায় নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে ২৩টিতে। অন্যগুলোর কাজ এতদিন অর্থ সংকটে করতে না পারলেও সম্প্রতি বরাদ্দ পাওয়ায় শিগগির কাজ শুরু বলে জানা গেছে।
তবে সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামের খাল ও নালাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজ করছে সিডিএ। তবে দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে।
সর্বশেষ শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাত ৮টায় নগরীর চকবাজারের কাপাসগোলায় অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালের পড়ে ছয় মাস বয়সী শেহরিজ এক শিশুর মৃত্যু হয়। শনিবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে চাক্তাইখালে ভেসে ওঠে তার মরদেহ। অথচ এ খালের পাড়ে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী রেলিং দেয় স্থানীয়রা। কিন্তু ধীরে ধীরে ওই রেলিং ভেঙে গেলে আর দেওয়া হয়নি।
এর আগে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর মোড়ে সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ বৃষ্টির সময় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। এতবছরেও সালেহ আহমেদের মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হলেও তার ছেলেকে চাকরি দেয় সিটি কর্পোরেশন। ওই বছরের ১২ অক্টোবর ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিমের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্কশপে সহকারী পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান মেয়রের তৎকালীন একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম। কিন্তু ওই বছরের ২১ নভেম্বর বিকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পাম্পে দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে রিজাইন লেটার জমা দিয়ে চাকরি ছাড়েন সালেহ আহমেদের ছেলে মহিম। চাকরি ছাড়ার কারণে হিসেবে তিনি জানান, তারা অফিসিয়াল কাজ দিবে বলেছিল আমাকে। এই চাকরিটা শুরু করার সময়ও আমাকে রিসিট লেখার কাজ বলেছিল। কাজ করতে গিয়ে দেখি আমাকে গাড়িতে তেল ভরানোর কাজ করতে হচ্ছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করতে হয় সেখানে। আমি পড়াশোনা করবো কখন?
এ ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. মিজানুর রহমান কমিটির প্রধান ছিলেন। তাদের তদন্তে উঠে আসে, নালায় তলিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায় উভয় সংস্থারই রয়েছে।অধিকাংশ নালা ও খাল দীর্ঘদিন ধরে খোলা পড়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নেই কোনো ব্যারিকেড, সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড কিংবা আলোর ব্যবস্থাও।
একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা যান। ওই নালার ওপর কোনো ধরনের স্ল্যাব ছিল না।
২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু কামাল। তিনদিন পর মুরাদপুর থেকে উদ্ধার হয় তার মরদেহ। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ায় উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৭ ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার হয় তার মরদেহ ফায়ার সার্ভিস।
২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পাওয়া যায় তার মরদেহ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে ১৬ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলোতে খাল পুনঃখনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, রেগুলেটর স্থাপন এবং সড়ক নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় থাকা খাল-নালা দীর্ঘদিন ধরে উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
চট্টগ্রাম শহরের খাল পুনঃখনন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল পুনঃখনন ও সংস্কার করার কথা ছিল। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে খাল উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা সমস্যায় প্রকল্পটি এখনো শেষ করা যায়নি।
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন ও ১৯ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। তবে নানা কারণে এই প্রকল্পের কাজেরও যথাযথ অগ্রগতি হচ্ছে না।
সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যেসব জায়গা দিয়ে খাল প্রবাহ হয়েছে সেসব প্রায় খালঘেষেঁ রয়েছে চলাচলের রাস্তা। আবার অনেক খালঘেষেঁ রয়েছে বসতঘর। অনেক ঘরের বাসিন্দারা ছোট বাচ্চা নিয়ে খালের পাড়েই বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে, আবার অনেকে ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিয়ে খোশগল্পে ব্যস্ত। এসব খালে নেই কোনো ধরনের রেলিং।
চকবাজার, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, পথচারী চলাচলের জন্য নালার ওপর বসানো স্ল্যাবের অনেকগুলো নেই। আবার অনেক স্ল্যাব রয়েছে ভাঙা, যে কোনো মুহূর্তে এসব ভাঙা স্ল্যাবে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন মানুষ। সম্প্রতি নালা থেকে ময়লা পরিষ্কার করায়, অনেকগুলো স্ল্যাব ভালোভাবো বসানো হয়নি, আবার অনেকগুলো ভেঙে গেছে। ফলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কেন এত মৃত্যু, কেন নিরাপত্তাহীনতা—জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘চট্টগ্রামের খাল ও নালাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। অন্যদিকে খাল সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করছে সিডিএ। কিন্তু দুই সংস্থার কারোই কাজ সুশৃঙ্খল ও সমন্বয় না থাকার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী।’
তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চারটি প্রকল্প চলমান থাকলেও প্রকল্প স্থানগুলোতে পথচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬টি খাল আমাদের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।’
প্রকৌশলী হাসান বিন সামস আরও বলেন, ‘শিশু শেহরিজের মৃত্যুর দায়ভার আমরা এড়াতে পারি না। শিশুটি যে খালে তলিয়ে গেছে, সেটি আমাদের জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় ছিল। কিন্তু অর্থ সংকটে আমরা সেটিতে কাজ করতে পারিনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে আমরা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের বলেছিল ৭৫০ কোটি দেবে এবং বাকি ৭৫০ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ সুদে লোন নিতে। কিন্তু লোন নিলে আমরা শোধ করব কিভাবে? অর্থের সংস্থান না হওয়ায় আমরা হিজরা খালে কাজ করতে পারিনি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখন হিজরা খালে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কাজ শুরু করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
ডিজে