নারায়ণগঞ্জ শহরের সালেহনগর এলাকার আলী আহাম্মদ ও রহিমা বেগম দম্পতির ছেলে ইমরান আহম্মেদ (৪৬)। তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও পেশায় কবি ও লেখক। তার চারটি গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তার হাত-পা এবং শরীরের প্রায় সব অঙ্গই জন্মগতভাবে বিকল। দরিদ্র দিনমজুর পিতা-মাতার এ সন্তান অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি চলাফেরা, খাওয়া–দাওয়াসহ দৈনন্দিন কাজ করতে পারেন না। চলাফেরার জন্য একটি হুইলচেয়ার কেনার সামর্থ্যও না থাকা ইমরানের পাশে দাঁড়িয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। একসঙ্গে তার পরিবারের সঙ্গে খেয়েছেন রাতের খাবারও।
শুধু ইমরান নন, নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন লোকজনের পাশে দাঁড়িয়েছেন জাহিদুল ইসলাম। সহযোগিতার পাশাপাশি অনেককে অনুদানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। তবে এই জেলায় ১৬ নভেম্বর, রোববার ছিল তার শেষ কর্মদিবস। এদিন ফুলে ফুলে বিদায়ী ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন তিনি।
ইলেক্ট্রিক হুইলচেয়ার পেয়ে কবি ইমরান বলেন, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য—এই মহৎ বাণীটা আজ আমার জীবনে বাস্তব সত্য হয়ে ধরা দিল। দৈনন্দিন কাজকর্ম আমার বৃদ্ধ মা–বাবার কাঁধে চড়ে করতে হয়। এই দুর্ভোগের কথা ‘মায়ের আঁচল সাহিত্য সামাজিক মৈত্রী পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হারুনুর রশীদ সাগরের মাধ্যমে মানবতার মানুষ হিসেবে পরিচিত জেলা প্রশাসকের কানে পৌঁছে যায়।
তিনি বলেন, ডিসি স্যার একজন অভিভাবক ও মানবিক নেতার দায়িত্ববোধ নিয়ে আমার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আজ সেই আশ্বাস বাস্তবে রূপ নিল। ডিসি স্যার নিজ হাতে আমাকে অত্যাধুনিক একটি ইলেক্ট্রিক হুইলচেয়ার উপহার দিলেন। এটি শুধু একটি চেয়ার নয়—এটি আমার জীবনে নতুন আশার দিগন্ত, চলার পথে শক্তি, সাহস ও আলোর প্রদীপ।
এর আগে রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বিদায়ের সময় জেলা প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা–কর্মচারী ‘মানবিক ডিসিকে’ শুভেচ্ছা জানান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ–আহত পরিবার, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, দুস্থ মানুষ, অসহায় শিশু, কারাবন্দি, ঝুঁকিপূর্ণ রোগী—সবার ঠিকানা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহাগকে স্মার্টফোন, সালমা জেরিনকে ল্যাপটপ; ২০ প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার ও ইলেকট্রিক চেয়ার; বিশেষ স্কুলের শিশুদের শিক্ষা উপকরণ; অসহায় আজান, নাছিমা, আলভী, সিরাজুল ও ফয়সালসহ বহু রোগীর চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা, সবখানেই ছিল তার স্পর্শ।
জুলাই শহীদ ২১ পরিবারকে ৪২ লাখ টাকা, আহত ২১২ যোদ্ধাকে অনুদান, এতিমখানার ৮২ শিশুকে পাঞ্জাবি-ইফতার, কারাগারের ১ হাজার ২৪৪ বন্দির জন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট—সব জায়গায় তিনি মানবিকতার ছাপ রেখে গেছেন।
তিনি সবচেয়ে আলোচনায় আসেন—গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়ার পর।
হাসপাতালে নবজাতকের আইসিইউ চালু, খানপুর হাসপাতালে হুইলচেয়ার প্রদান, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে অত্যাধুনিক সিবিসি–ইসিজি মেশিন, ফুটবল একাডেমির শিশুদের জন্য বল–বুট ও টুর্নামেন্ট খরচ বহন—উন্নয়নেও রেখেছেন ভূমিকা।
এমনকি শতবর্ষী হকার ফজিলাতুন্নেছাকে খাদ্যসামগ্রী ও পুঁজি প্রদান, আর ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করতে না পারায় লাশ আটকে রাখা পিংকির মরদেহ ১৪ ঘণ্টা চেষ্টায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়াও তার মানবিকতার অনন্য উদাহরণ।
একদিনে ৩০ জন ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্য লটারিতে বদলি, মাত্র ১১২ টাকায় সরকারি চাকরির মাধ্যমে
স্বচ্ছতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সিজার বন্ধ হয়ে গেলে জেলা পরিষদ থেকে নতুন ডায়াথার্মি মেশিনের ব্যবস্থা করেন।
এর আগে ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে যোগ দিয়েই দ্রুত জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত চার হাজার পেঁয়াজ চাষির পাশে দাঁড়ানো, রাজবাড়ী কারাগারের বন্দিদের পুনর্বাসনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় দাতা সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে স্কুল চালু রাখার ব্যবস্থাও করেন তিনি।
মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে জন্ম। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে বড় হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে রাশিয়ান ভাষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন। পরে যুক্তরাজ্য থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমএসসি সম্পন্ন করেন।
২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ দেন। লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার ও নোয়াখালী—বিভিন্ন জেলায় এনডিসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমলগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে জেলার শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের মতে—বিদায়ী ডিসি জাহিদুল ইসলামকে তারা দীর্ঘদিন মনে রাখবেন তার মানবিকতা, বিনয় ও জনবান্ধব আচরণের জন্য।


