জামিন হলেও মুক্তি নেই, চট্টগ্রাম কারাগারের গেটেই ‘দরকষাকষি’র হাট

ছাত্রলীগ নেতার মুক্তি ঘিরে ডেপুটি জেলারকে আকস্মিক বদলি

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজনৈতিক মামলার এক বন্দিকে মুক্তি দিতে টাকার দরকষাকষির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর কারা অধিদপ্তরে তোলপাড় চলছে। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য আবু সাদাত মো. সায়েমকে মুক্তি দিতে দিনভর দরকষাকষির পর বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগের সত্যতা মেলার কথা জানা গেছে। এই ঘটনার জেরে কারাগারটির ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়াকে নজিরবিহীন একক আদেশে বদলি করা হয়েছে। শনিবার (১৫ নভেম্বর) বিষয়টি জানাজানি হয়।

চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে এসে পটিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য আবু সাদাত মো. সায়েমকে।
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে এসে পটিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য আবু সাদাত মো. সায়েমকে।

অভিযোগের আগুন

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কোনো মামলা না থাকা এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থাকার পরও সায়েমের মুক্তির জন্য তার স্বজনদের সাত লাখ টাকা দিতে হয়েছে চট্টগ্রাম কারাগারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের। এর আগ পর্যন্ত তাকে একটানা বসিয়ে রাখা হয় কারাগারের গেইটে। এই অভিযোগ সামনে আসার পরপরই কারা অধিদপ্তরে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। বদলির আদেশটি যে আকস্মিক এবং শাস্তিমূলক, সংশ্লিষ্টদের মতে এতে তেমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

এ ঘটনার জেরে ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়াকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) তার এই আকস্মিক বদলির আদেশ আসে। কারা প্রশাসনে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের মন্তব্য, শাস্তিমূলক বদলি ছাড়া ডেপুটি জেলার পর্যায়ে একক আদেশে বদলির নজির নেই। তারা মনে করছেন, এ ঘটনায় বড় কর্মকর্তাদের ছাড় দিয়ে মাঝারি স্তরের ওই কর্মকর্তাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছে।

বসিয়ে রেখে দরকষাকষি

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রাম কারাগারে জামিন বাণিজ্য একটি ‘ওপেন সিক্রেট’। জামিন পাওয়ার পরও অনেক বন্দিকে সুপার, জেলার থেকে কারারক্ষী পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার ছাত্রলীগ নেতার মুক্তি নিয়ে বড় বাণিজ্যের বিষয়টি গোপন সূত্রে ঢাকার কারা অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজরে এলে তারা ব্যবস্থা নেন।

জানা গেছে, জামিন পাওয়ার পর ছাত্রলীগ নেতা আবু সাদাত মো. সায়েমকে কারাগারের অফিসকক্ষে এনে বসিয়ে রাখা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (ডিএসবি) জানায় এবং কিছুক্ষণ পর পুলিশ ক্লিয়ারেন্সও চলে আসে। এরপরই তাকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়। শেষে বড় অঙ্কের টাকায় রফা হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান। অভিযোগ রয়েছে, এই দরকষাকষির বিষয়টি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কারাগারে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও অবগত ছিলেন।

জানা গেছে, জামিন পাওয়ার পর আবু সাদাত মো. সায়েমকে কারাগারের অফিসকক্ষে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (ডিএসবি) জানায় এবং সেখান থেকেও ক্লিয়ারেন্স আসে। এরপর সায়েমকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ভয় দেখিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। বড় অঙ্কের টাকা দিতে সম্মত হওয়ার পর মুক্তির পথ খুলে যায়।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারাগারের সব উর্ধতন কর্মকর্তা জানতেন। এমনকি স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্বরত কর্মকর্তারাও এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

১০ মাস আগে গ্রেপ্তার হন সায়েম

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য আবু সাদাত মো. সায়েমকে (৪৩) গত ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থেকে গ্রেপ্তার করে পটিয়া থানা-পুলিশ। তিনি পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের মৃত নুরুল আনোয়ারের ছেলে। পুলিশ তখন জানিয়েছিল, গ্রেপ্তারের পর সায়েমের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের ইলিয়াছ খাঁর বাড়ি এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে একটি দেশে তৈরি এলজি উদ্ধার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, হত্যার চেষ্টা এবং অস্ত্র আইনে মোট ছয়টি মামলা রয়েছে। গত ৪ আগস্ট পটিয়ায় মাদ্রাসা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে তার নেতৃত্বে হামলা করা হয় বলে পুলিশ অভিযোগ এনেছিল।

ক্লিয়ারেন্সের নামে ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য

চট্টগ্রাম কারাগারে রাজনৈতিক মামলায় কোনো আসামি জামিন পেলে কারা কর্তৃপক্ষ তা মহানগর পুলিশের সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানায়। তাদের ক্লিয়ারেন্স এলেই আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় পুলিশ কাকে ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে বা দিচ্ছে না, সে বিষয়ে বন্দিরা অন্ধকারে থাকেন। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্দিদের ‘আরও মামলা আসছে’ বা ‘এক বছরেও ছাড়া পাবেন না’ বলে ভয় দেখান। তখন মুক্তির আশায় বন্দিরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে টাকার দেনদরবার শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান রাজনৈতিক বন্দিদের কাছ থেকে এভাবে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হয়।

কারা কর্মকর্তারা যা বললেন

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও ওই ছাত্রলীগ নেতাকে কেন সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়েছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ্ শরীফ দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার মামলায় আটক ব্যক্তিদের জামিন হলেও অধিকতর অনুসন্ধানের স্বার্থে প্রতিদিনই এরকম অনেককে বসিয়ে রাখা হয়’।

তিনি দাবি করেন, ওই ছাত্রলীগ নেতার মুক্তি নিয়ম মেনে হয়েছে এবং কোনো অর্থ লেনদেনের অভিযোগ তিনি পাননি।

বদলির কথা স্বীকার করে ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘দুই বছর পূর্ণ হওয়ায় আমাকে বদলি করা হয়েছে’। তবে ছাত্রলীগ নেতার মুক্তির ঘটনায় তাকে বদলি করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন করতেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

অন্যদিকে কারাগারে দায়িত্বরত চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (ডিএসবি) সদস্য আল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না’। তিনি এ বিষয়ে ডিএসবির ফোকাল পারসনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

নেতার সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার

এদিকে এই দরকষাকষির ঘটনায় ‘জুলাই ঐক্য’ নামের একটি সংগঠনের নেতার সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখার সাবেক আইন সম্পাদক ও বর্তমানে জুলাই ঐক্যের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংগঠক আবরার হাসান রিয়াদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এই ঘটনায় আমার নাম ওঠার ন্যূনতম কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কে করলো, কে তুললো?’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আবরার হাসান রিয়াদ বলেন, ‘ডেপুটি জেলার নওশাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আগে থেকে একটি সম্পর্ক ছিল। কয়েক দিন আগে আমি কারাগারে নওশাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম’। রিয়াদ জানান, এ সময় এক বন্দি তাকে দেখে ‘ভাই আমাকে কি চিনতে পারছেন? আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আপনাকে অনেকবার দেখেছি। আমার নাম সায়েম’ বলে সম্বোধন করেন।

রিয়াদ বলেন, ‘আমি তাকে (সায়েম) চিনিই না। কোতোয়ালী-চকবাজার-পাঁচলাইশে প্রচুর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতা অ্যারেস্ট হইছে আমার উদ্যোগে। আড়াই বছর আমি ছাত্রশিবিরের আইন সম্পাদক ছিলাম। এখন আমি জুলাই ঐক্যের প্রধান সমন্বয়কারী। এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হচ্ছে মূলত আমার ইমেজ ও ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, যার বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই।’

সিপি

ksrm