এক্সক্লুসিভ/ মিয়ানমারের গহীন বনে অনলাইন প্রতারণার ভয়ংকর চক্রে বাংলাদেশি যুবকরা
১৭ বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে এক বাংলাদেশির অবিশ্বাস্য লড়াই
জুনায়েদ হোসেন পারভেজ হয়তো জানতেন না তার জীবন হবে সিনেমার গল্পের মতো। তবে সিনেমার গল্পের মতো মনে হলেও বাস্তবতা ছিল কঠিন ও ভয়ঙ্কর। উন্নত জীবন আর ভালো থাকার আশায় বেশি বেতনের চাকরির প্রস্তাবে, ২০২৪ সালে জুনায়েদসহ আরও ৪ বাংলাদেশি দুবাই থেকে থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। কিন্তু থাইল্যান্ড সীমান্তের গহীন অরণ্যে মিয়ানমার অংশে থাকা ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ তাদের জিম্মি করে মানবপাচার চক্র। এরপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মুক্তিপণ দাবি, অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা এবং প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি।

এর মধ্যে আরও ১৩ জন বাংলাদেশি মানবপাচারের শিকার হয়ে ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ আটকে পড়ে। এরপর সুযোগ পেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে বেঁচে ফেরেন জুনায়েদ। তিনি নিজে বেঁচে ফিরলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়ে গেছেন অন্যান্য বাংলাদেশিদের মুক্ত করতে। দুবাই-পাকিস্তান-মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ড হয়ে কিভাবে তিনি স্বদেশিদের মুক্ত করেছেন, সেই ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন তিনি। অথচ তাকে মেরে ফেলার জন্য ৫০ হাজার ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করে মানবপাচারকারীরা।

জুনায়েদ ছাড়া মানবপাচারের শিকার হয়েছেন, এমন কয়েকজন হলেন—রাজবাড়ি জেলার মো. ইমরান, শরিয়তপুর জেলার মো. উজ্জ্বল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মো. ফয়সাল মিয়া, কুমিল্লা জেলার তুয়ানুর খলিলুল্লাহ, লক্ষ্মীপুর জেলার ওমর ফারুক, নোয়াখালী জেলার মো. ইসমাইল হোসেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার সায়মন হোসেন আবির, পতেঙ্গা এলাকার মো. কাইসার হোসেন। তবে অপর আট জনের পরিচয় জানা যায়নি।

এদিকে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যে ১৭ জন বাংলাদেশি চীনা মাফিয়াদের হাতে মায়ানমারে জিম্মি ছিল, গত ২৩ জানুয়ারি তাদের ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি উদ্ধার করলেও থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশি জিম্মিরা দেশে ফেরার অপেক্ষায় ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মির হেফাজতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

যেভাবে ফাঁদে পড়েন পাঁচ যুবক
২০২৪ সালে ১১ আগস্ট, গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে দুবাই থেকে থাইল্যান্ড যান পাঁচ যুবক। খবর পেয়ে কাইছার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পূর্বপরিচিত বন্ধু নোমান। নোমান তাদের জানান, ‘থাইল্যান্ডে ভালো বেতনের আইটিতে কাজ করার সুযোগ আছে। কম্পিউটার অপারেটরের কাজ, মাসে ১২০০ মার্কিন ডলার বেতন’। তার কথা শুনে জুনায়েদ বলেন, ‘থাইল্যান্ডে কাজ করার জন্য আমাদের কোনো ওয়ার্ক ভিসা নেই’। তখন নোমান বলেন, ‘ওয়ার্ক ভিসার প্রয়োজন নেই, এটি একটি স্বল্পমেয়াদি চীনা প্রকল্প। বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে তিন মাস কাজ করতে পারবেন’।

নোমানের এমন প্রস্তাবে কোম্পানি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান পাঁচ যুবক। এরপর নোমান কৌশলে একজন চীনা নাগরিককে দিয়ে টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাদের সাক্ষাৎকার নেন। যেখানে ইংরেজি এবং কম্পিউটার জ্ঞান সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন করা হয়। ইন্টারভিউ শেষে পাঁচ বাংলাদেশিকে চাকরির জন্য নির্বাচিত করা হয়।

জুনায়েদ বলেন, পরের দিন ১২ আগস্ট একজন থাই নাগরিক একটি গাড়ি নিয়ে আসেন ‘মায়েসট’ কোম্পানিতে নিয়ে যেতে। প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর গাড়িচালক আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট চাইলো। আমরা কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাক প্রদেশের ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টে পুলিশ থাই ভাষায় তাদের উদ্দেশ্য জানতে চাইবে, যা তিনি তাদের হয়ে ব্যাখ্যা করবে’। চেকপয়েন্ট পার হওয়ার পর চালক আমাদের ইরাওয়ান হোটেলে নিয়ে যায়। এরপর আগের চালক আমাদের অন্য আরেকজন চালকের কাছে হস্তান্তর করে বলেন, ‘তিনি তাদের কোম্পানিতে নিয়ে যাবেন’। প্রথম চালক দ্বিতীয় চালকের কাছে পাঁচজনকে হস্তান্তরের সময় বড় অংকের থাই বাথ (থাইল্যান্ডের মুদ্রা) লেনদেন করেন। দ্বিতীয় চালক দ্রুত থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের দিকে গাড়ি চালাতে থাকেন।

তিনি বলেন, সীমান্তে পৌঁছার পর দেখি, সেখানে আগে থেকেই রাইফেলধারী ৮-৯ জন লোক। তারা আমাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সীমান্তের দিকে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা মোয়ে নদীর কাছে পৌঁছাই। অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের দু’দলে ভাগ করে দুটি নৌকা করে নদী পার হয়ে মিয়ানমারে পৌঁছায়। সীমান্ত পার হওয়ার পর একটি ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ নেওয়া হয় পাঁচজনকে। নিরাপত্তারক্ষী পাসপোর্ট, ভিসা, মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জব্দ করার পর প্রবেশের অনুমতি দেয় আমাদের।
কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হিমেল মিয়ার বলেন, ‘ধার দেনা করে ছোট ভাইকে দুবাই পাঠিয়েছিলাম। মানবপাচারের শিকার হয় আমার ভাই। কাজ করতে না পারলে তার ওপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। প্রাণ বাঁচাতে ছোট ভাইয়ের আকুতির কথা মনে পড়লে, রাতে ঘুম আসে না।’
জোর করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর
অপহরণের পরদিন পাঁচজনকে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য বলা হয়। চুক্তিপত্রে লেখা ছিল—এই চুক্তি ১৮ মাসের জন্য বৈধ এবং প্রত্যেককে কোম্পানির জন্য ২,০০,০০০ মার্কিন ডলার উপার্জন করতে হবে। যদি তারা এই অর্থ উপার্জন করতে না পারে, তবে তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজের পেছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হবে। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক এবং খাদ্য বঞ্চনার মতো কঠিন শাস্তিও দেওয়া হবে।
জুনায়েদ বলেন, এমন চুক্তিপত্র দেখে পাঁচজন রাজি হইনি। নিজেরাই গাড়ি ভাড়া দিয়ে পুনরায় থাইল্যান্ডে ফিরে যেতে চাইলে তাদের বৈদ্যুতিক শক দিয়ে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শুরু হয়। এরপর জোর করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হয়। চীনারা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের এখানে জিম্মি করে জোর করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে প্রতারণামূলক কাজ করায়। মানবপাচারের শিকার ইথিওপিয়া, উগান্ডা, চীন, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে। প্রত্যেককে একটি করে কম্পিউটার এবং কয়েকটি মোবাইল ফোন দেওয়া হয়।
শেখানো হয় প্রতারণার কৌশল
কম্পাউন্ডে তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেখানে চীনারা নির্দেশ দেয়, কিভাবে রুশ মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে। কিভাবে এআই ব্যবহার করে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ভিডিও কল করতে হবে।
জুনায়েদ বলেন, প্রতিদিন রাশিয়া, তুরস্ক, আজারবাইজান এবং অন্যান্য আশেপাশের দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ৮০ জনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। চীনা বস তাদের কাজ করার সময় হাসতে বলেন এবং সেই ভিডিও রেকর্ড করে বাংলাদেশি মানবপাচারকারী চক্রের দালাল নোমানের কাছে পাঠান। সেই ভিডিও বাংলাদেশের তরুণদের দেখিয়ে, ভালো বেতনের আইটিতে চাকরির প্রলোভন দিয়ে থাইল্যান্ডে পাঠান। একই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারে পাচার করে চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন।
এভাবেই মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম একজন মূল হোতা নোমান প্রতারিত করে ১৭ জন বাংলাদেশিকে মিয়ানমারে চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে ‘ঝংফা কোম্পানিতে’ ৪৭ জন কাজ শুরু করলেও পুরো কম্পাউন্ডে ৪০০-৫০০ জন মানুষ ছিল বলে জানান জুনায়েদ।
প্রতারণার যত ধরন
জুনায়েদ বলেন, যখন আমরা কোনো ক্লায়েন্ট খুঁজে পাই, প্রথমে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করি এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করি। বিশ্বাস অর্জনের জন্য মাঝে মাঝে VIVED অ্যাপ ব্যবহার করে ভিডিও কল করি। যখন ক্লায়েন্টরা আমাদের কল করে, আমরা ফোনটি আমাদের মডেলের কাছে দেই, কিন্তু মডেল ছিল ভিন্ন একজন মেয়ে, যার ছবি আমাদের ভুয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করা হতো। মডেল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং তারা দেখতে পায় যে মডেল গাড়ি চালাচ্ছে বা ক্লাবে নাচছে।
মডেল সাধারণত শুধু হাই বা হ্যালো বলে কল কেটে দেয় এবং বলেন, আমি এখন ব্যস্ত, পরে কল করব। যখন ক্লায়েন্টরা আমাদের বিশ্বাস করতে শুরু করে, আমরা বলি যে, আমি আমার অবসর সময়ে Amazon এবং Shopee-এর মতো অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মে কাজ করি এবং প্রতিদিন ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি আয় করি। তুমি আমার প্রিয় বন্ধু বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, তাই আমি তোমাকে শেখাতে পারি, কীভাবে সহজ কিছু দৈনন্দিন কাজ করে এখান থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারো।
যখন তারা আমাদের কাছ থেকে শিখতে রাজি হয়, তখন আমরা তাদের আমাদের কোম্পানির দেওয়া ভুয়া অ্যাপ পাঠাই। কোম্পানির প্রশিক্ষণ অনুযায়ী, আমরা স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী বার্তা পাঠাই। তাদের ক্রিপ্টো ওয়ালেট তৈরি করতে এবং USD কিনতে নির্দেশ দেই। যখন কেউ ক্রিপ্টো ওয়ালেট তৈরি করতে এবং USD কিনতে রাজি হয়, তখন চীনা সুপারভাইজার এবং অন্যান্য চীনা বসরা কথোপকথনের দায়িত্ব নিয়ে তাদের ধাপে ধাপে ক্রিপ্টো ওয়ালেট তৈরি এবং USD কেনার পদ্ধতি শেখায়। তারা কাজ এবং তথাকথিত লাভের স্ক্রিনশটও পাঠায়। নির্দেশনা অনুসরণ করে যখন তারা ৫০০ USD বিনিয়োগ করে, তখন কোম্পানি তাদের ১০০-২০০ USD লাভ দেয়।
টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হলেই চলে নির্যাতন
বন্দিদশায় কোনো ছুটি ছিল না জিম্মি ব্যক্তিদের। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত টানা ১৪-১৭ ঘণ্টা কাজ করার পরও মারধর করা হতো। ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। শুধু তাই নয়, ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অন্ধকার কক্ষে নির্যাতন করা হতো। বন্দিদের নিজেদের মধ্যে কোনো সখ্যতা, বন্ধুত্ব কিংবা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়ে ছিল কঠোর সতর্কবার্তা। দেশে কিংবা পরিবার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনা সুযোগ নেই।
জুনায়েদ বলেন, প্রতিটি কক্ষে সিসিটিভির পাশাপাশি কথা শোনার মত ডিভাইস লাগানোর থাকে। বিনা পারিশ্রমিকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দাসত্ব মেনে নিয়ে পরিশ্রম করে যেতে হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বিক্রি করে দেওয়া হয় আরেক কোম্পানিতে। এভাবে বছরের পর বছর বিভিন্ন কোম্পানির কাছে হাতবদল হতে থাকে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীরাই জিম্মিদের দেখাশোনা করে। তাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, কেউ চুরি করে পালিয়ে যেতে চাইলে সরাসরি গুলি করার। তাই প্রাণের ভয়ে কেউ পালাতে পারে না। কখনও কেউ মারা গেলে মরদেহ জঙ্গলে কিংবা নদীতে ফেলে দেয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনে ঘটনাস্থলে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে অনেকবার।
জিম্মিদের মুক্তিপণের জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে চাওয়া হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। মুক্তিপণ দেওয়ার পরও অনেককে আটকে রাখা বলে জানান জুনায়েদ।
জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন জুনায়েদ
২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর মিয়ানমারের ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ মো. আলী নামে এক পাকিস্তানি নাগরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রক্তবমি শুরু করেন। তখন চীনা বস দু’জন নিরাপত্তারক্ষীসহ জুনায়েদকে দায়িত্ব দেন আলীকে ক্লিনিকে ভর্তি করানোর জন্য। আলীকে ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পর জুনায়েদ রাত ১১টায় মোয়ে নদীর দিকে হাঁটেন আর মনে মনে পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। তার হঠাৎ নজরে আসে, সঙ্গে থাকা নিরাপত্তারক্ষী ওয়াচ টাওয়ারের নিচে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। তখন সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে নদীতে ঝাঁপ দেন জুনায়েদ। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ শুনার পর পরই নিরাপত্তারক্ষীরা অন্ধকারের মধ্যে চার রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জুনায়েদ প্রায় ৪০ মিনিট নদীতে সাঁতারে তীরে পৌঁছায়। এরপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে খালি পায়ে জঙ্গলের ভেতর দৌড়াতে শুরু করেন। দৌড়াতে গিয়ে পায়ের বেশ কিছু স্থানে আঘাতও পান। মোকাবিলা করতে হয় কুকুরের আক্রমণও।
জুনায়েদ বলেন, কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর মহাসড়ক খুঁজে পেলেও কিছু বাইক আরোহীদের মহড়া দেখে সারারাত জঙ্গলে কাটাই। ভোর হওয়ার পর মহাসড়কে হাঁটা শুরু করি, কিছুক্ষণ পর একটি সাইনবোর্ড দেখতে পাই। যেটিতে ২ কিলোমিটার সামনে একটি স্কুলের অবস্থান এবং মায়সট একইদিকে নির্দেশিত ছিল। এরপর একজন মোটরসাইকেল আরোহীর সহযোগিতা চাইলে তিনি আমার কথা বুঝতে না পেরে একটি মন্দিরের পুরোহিতকে ফোন করেন। ফোনে পুরোহিতকে আমার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি।
তিনি বলেন, পরে বাইকার আমাকে মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে পুরোহিতের ফোন ব্যবহার করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরিবারের কাছ থেকে থাইল্যান্ডে একটি এনজিও সংস্থার ফোন নম্বর পাই। এনজিও সংস্থার কর্মকর্তারা দ্রুত থাইল্যান্ডের পুলিশের সঙ্গে মন্দিরে উপস্থিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ভর্তি করান। চিকিৎসা শেষে মায়সট মানবপাচার শিকার সহায়তা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানে নিজেকে মানবপাচারের শিকার হিসেবে চিহ্নিত করি এবং সমস্ত কাগজপত্র সম্পন্ন হওয়ার পর ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর দেশে ফিরি।
মানবপাচারের মূলহোতা যেভাবে গ্রেপ্তার
জানা গেছে, দেশের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, রাজবাড়ি, কুমিল্লা, নরসিংদি, ব্রাক্ষণবাড়িয়া আদালতে ইফতেখারুল আলম রনি ও মো. নোমানের বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন- ২০১২ এর ৬/৭/৯/১০ ধারায় একাধিক মামলা রয়েছে।
২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে রনির বিরুদ্ধে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইবুনাল নং-২, কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে।
এছাড়া ১১ জানুয়ারি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানায় তার বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন- ২০১২ এর ৬/৭/৯/১০ ধারায় একটি মামলা করা হয়। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর মানবপাচারের অন্যতম হোতা ইফতেখারুল আলম রনি এবং মো. নোমানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়। রনির বাড়িতে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে গোয়েন্দা সংস্থা।
২০ ডিসেম্বর মামলার বাদি মো. হিমেল মিয়ার বাড়িতে এসে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তার ছোট ভাইকে ফেরত আনার অঙ্গীকার করেন রনি। এরপর ৭ দিন পেরিয়ে যায়, রনির কথা ও কাজের কোনো মিল না পেয়ে ২৯ ডিসেম্বর ফেনীর সদরে রনির ভাড়া বাসায় গেলে আবারও এক সপ্তাহের সময় নেন তিনি।
এরপর রনি তার মুঠোফোন বন্ধ করে দেন এবং বাসা বদলে আত্মগোপনে চলে যান। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের বিজি-১৪৭ ফ্লাইটে দুবাই যেতে চেয়েছিলেন রনি। কিন্তু গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করে এনএসআই। পরে তার বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় ইমিগ্রেশন পুলিশ মামলা করে। তবে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে মো. নোমান।
ইয়াঙ্গুন মিশনের রিপোর্টে যা ছিল
ঢাকায় পাঠানো মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন মিশনের রিপোর্টে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সেইসঙ্গে মিশনের পদক্ষেপের কিছুটাও উল্লেখ ছিল। সেই রিপোর্ট মতে, ২০২৪ সালের আগস্টে ১৫ জন বাংলাদেশি নাগরিকের একটি তালিকা পায় বাংলাদেশ মিশন। যারা স্ক্যাম সেন্টারে আটক রয়েছেন। ১৫ জনের মধ্যে ৪ জনের দুবাইয়ে অবস্থানের ভিসা ছিল। বাকিরা বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান। সেখান থেকে ভ্রমণ ভিসা জোগাড় করে থাইল্যান্ড পৌঁছান। মিয়ানমারের শহরের প্রান্তে ‘ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি’ নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর দখলে।
বুড্ডিস্ট আর্মি এবং থাইল্যান্ডের বর্ডার গার্ড সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করায় ভিসা ছাড়া লোকজন মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারে। ফলে মিয়ানমার ইমিগ্রেশনের কাছে বাংলাদেশি কতজন প্রবেশ করলো, সে তথ্য থাকে না।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনভিত্তিক ফরেন ফান্ডেড এনজিও’র মাধ্যমে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে ঢাকাকে জানায় বাংলাদেশের ইয়াঙ্গুন মিশন।
বাংলাদেশিদের উদ্ধারে নেই অগ্রগতি
বাংলাদেশের ১৭ জন নাগরিক মিয়ানমারের জিম্মি আছে। এ বিষয়ে ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে লিখিত জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, এজেন্সি ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ইন্দোনেশিয়া, ইথোপিয়া, পাকিস্তান, মালেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, নেপাল, শ্রীলংকা, উগান্ডাসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের উদ্ধারের তৎপরতায় বেড়ে যায়। ২০২৫ সালের ৪ জানুয়ারি আবারও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে মিয়ানমারে বন্দি বাংলাদেশিদের উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। অথচ মিয়ানমারের ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টার’ থেকে জানুয়ারিতেই বিভিন্ন দেশের ৬১ জন জিম্মি নাগরিককে উদ্ধার হয়।
জিম্মিদের বাঁচাতে জুনায়েদের লড়াই
জুনায়েদ বাংলাদেশে ফেরার পর ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে মানবপাচারের শিকার প্রবাসীদের উদ্ধারে হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ভুক্তভোগীদের পরিবার জুনায়েদের কাছে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা চান। এরপর শুরু হয় জিম্মিদের মুক্ত করতে জুনায়েদের এক অন্য লড়াই।
জুনায়েদ বলেন, আমি পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছি। কিন্তু আমার পরিবার এ কাজে বাধা দেয়। এরপর থেকে তারা একপ্রকার কথাবার্তা বন্ধ করে দেয় আমার সঙ্গে। কিন্তু আমি জিম্মি প্রবাসীদের উদ্ধারে আবারও থাইল্যান্ডে এসেছি। আমার সব খরচ বহন করেছে ভুক্তভোগীদের পরিবার।
তিনি বলেন, ভিসা রিনিউ করে ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর দুবাই যাই। দুবাই গিয়ে জানতে পারি, মিয়ানমারের মানবপাচার চক্র আমাকে মেরে ফেলার জন্য ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের হাত থেকে বাঁচতে ২৮ ডিসেম্বর পাকিস্তান যাই। সেখান থেকে যাই মালয়েশিয়া। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি মালয়েশিয়া থেকে ভিসা করে থাইল্যান্ডে পৌঁছাই। থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পর প্রথমেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মিয়ানমারের মানবপাচার চক্রের হাতে জিম্মি থাকা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বর্ণনা তুলে ধরি।
জুনায়েদ আরও বলেন, থাইল্যান্ডের থাই পিপিএস থাইরা টিভি এবং দ্যা রিপোর্টার্স, জাপানের টিভি চ্যানেল নিপ্পন টিভিসহ একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিই। সর্বশেষ বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, কাজ চলছে। এভাবে দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে—কিন্তু কোনা সুরাহা হচ্ছে না। এক পর্যায়ে এভাবে প্রতিটি জায়গা থেকে ফেরত আসার পর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু এরপরও হাল ছাড়িনি।
থাইল্যান্ডে অবস্থিত ব্যাংককের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ইন্টারপোল সদর দপ্তরে যোগাযোগ করে জুনায়েদ সকল জিম্মি বাংলাদেশিদের কাগজপত্র জমা দেন। এর মধ্যে এক চাইনিজ নাগরিককে মিয়ানমারে জিম্মি করার ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। তখন চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের নাগরিকদের মুক্তি দিতে চাপ সৃষ্টি তৈরি হয়। এর পরিপেক্ষিতে মানবপাচারকারী চক্র প্রথম দফায় ৪০০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয়, যার মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক ফয়সালও ছিল।
ফয়সালের সঙ্গে দেখা করে বাকি বাংলাদেশিদের খবর জানতে চান জুনায়েদ। ফয়সাল জানান, বাংলাদেশি নাগরিকদের মুক্তি দিতে নারাজ মানবপাচার চক্র। এরপরও জুনায়েদ বিভিন্ন দপ্তরে চেষ্টা চালিয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে রাশিদুল ও ইমরান নামে আরও দুই বাংলাদেশিকে মুক্ত করেন।
দুই বাংলাদেশি জানান, অজানা এক কক্ষে আটক রয়েছে অন্যান্য বাংলাদেশিরা। তাদের ভিডিও চিত্রসহ মানবেতর জীবন নিয়ে ‘দ্যা রিপোর্টার্স’-এ একটি প্রতিবেদন করা হয়। সেই প্রতিবেদন বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানোর পর মিয়ানমারের মানবপাচার চক্র ১৭ বাংলাদেশিদের মুক্তি দেয়। বর্তমানে তারা মুক্ত হয়ে থাইল্যান্ড সীমানায় আছে। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিবার বসে আছে ছেলেদের প্রতীক্ষায়
মানবপাচারকারীর হাতে জিম্মি পতেঙ্গা এলাকার মোহাম্মদ কাইছার হোসেনের মা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে কাইছার দুবাই থেকে থাইল্যান্ডে গিয়েছে ভালো বেতনে চাকরি করার জন্য। মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পরে আমার ছেলেসহ অন্যান্য বাংলাদেশিরা থাইল্যান্ড সীমান্তের গহীন অরণ্যে, মিয়ানমার অংশে থাকা ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ জিম্মি আছে। গত ছয় মাসে আমার ছেলের সঙ্গে তিনবার যোগাযোগ করতে পারলেও বাকি তিন মাস আর যোগাযোগ হয়নি। তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। আমার ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবো কিনা জানি না। তবে দুদিন আগে সংবাদ পেলাম আমার ছেলেসহ আটক বাংলাদেশিরা মুক্তি পেয়ে খুব শীঘ্রই দেশে ফিরবে। আল্লাহর কাছে আমার ছেলে ফিরে আসুক, শুধু এইটুকু চাই।’
রাজবাড়ি জেলার বাসিন্দা মো. ইমরানের বোন মৌসুম আক্তার সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। ধার-দেনায় জর্জরিত মৌসুমি বলেন, ‘মানবেতর দিন কাটাচ্ছি। অসুস্থ বাবা-মা’র ওষুধ, ছোট বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছি। একবেলা খেয়ে দিন কাটছে। সত্যি বলতে, আমার ভাইকে জীবিত ফিরে পাবো—তা কল্পনাও করিনি।’
ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী দু’দিনের মধ্যে ওরা থাইল্যান্ডে পৌঁছাবে। তারপর ওখান থেকে বাংলাদেশে ফিরবে। আমরা সকল ভুক্তভোগী পরিবার জুনায়েদ হোসেন পারভেজের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে জিম্মিদের উদ্ধার করতে দেশ-বিদেশে একাই সংগ্রাম করে গেছেন।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘থাইল্যান্ড সীমান্তের গহীন অরণ্যের মিয়ানমার অংশে থাকা ‘অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারে’ জিম্মি বাংলাদেশিদের পরিবারগুলো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। জিম্মিদের উদ্ধার করতে আমি নিজেই থাইল্যান্ড গিয়েছি, ওখানকার বাংলাদেশ দ্রুতাবাস, রাস্ট্রদূতসহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ সঠিক তথ্য না জেনে, না বুঝে, কোনো কিছুর যাচাই-বাচাই না করে, উচ্চ বেতনের লোভে ফাঁদে পা দিচ্ছে। তাদের কাছে প্রবাসে যাওয়াটাই সব। কীভাবে গেল, সেটা মুখ্য নয়। মধ্যপ্রাচ্যে আটকে পড়াদের মধ্যে চট্টগ্রামের সংখ্য বেশি। তারা যে মানবপাচারকারীর খপ্পরে পরে নিঃস্ব হচ্ছে, তারা সেটি বুঝতেই পারে না। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে কোনো একটি দেশে যাওয়ার সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট দেশে যাওয়ার পর দেখা গেল, সেখানে তাদের কাজ নেই, তারা প্রতারিত হচ্ছে। মানবপাচারের শিকার হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশিকে বিদেশের মাটিতে জেল-জরিমানাসহ বিভিন্ন জটিলতায় আটকা পরতে হয়। গত এক বছরে ৪ হাজার মানবপাচারের মামলা তদন্তে আছে।’
ইপসার ফোকাল পার্সন যীশু বড়ুয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষায় দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ইপসা। চট্টগ্রাম বিভাগে ২০১৯-২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫৩৭ জনকে মানবপাচারের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা গেছে। ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে ৫০০ জন মানুষ মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। কক্সবাজারে মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষাসেল করা হয়েছে।’
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) বলছে, সমুদ্রপথ দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেসব দেশের মানুষ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, মানবপাচার নির্মূলের ন্যূনতম মান পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
জিম্মিদের দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেই বাংলাদেশ দূতাবাসের
যে ১৭ জন বাংলাদেশি চীনা মাফিয়াদের হাতে মায়ানমারে জিম্মি ছিল, গত ২৩ জানুয়ারি তাদের ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি উদ্ধার করেছে। বর্তমানে তারা ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মির হেফাজতে চরম খাদ্য সংকটে আছেন। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া তাদের ৮৪ জন নাগরিককে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও বাংলাদেশের ১৭ জন নাগরিকদের এখনও পর্যন্ত থাইল্যান্ডে থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে উদাসীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস। এদিকে ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি বার বার আহ্বান জানাচ্ছেন প্রত্যেক দেশের দূতাবাস যেন তাদের নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশের নাগরিকেরা এখন মানবিক সংকটের পাশাপাশি জীবনের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জুনায়েদ হোসেন পারভেজ বলেন, আমি মিয়ানমার উইং ও থাইল্যান্ডের অ্যাম্বাসিসহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছি এবং আটকে থাকা বাংলাদেশি এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ সমানতালে চলছে।
ডিজে