চট্টগ্রামের মিরসরাই ট্র্যাজেডির আজ ১১ বছর। ২০১১ সালের ১১ জুলাই মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন শিক্ষার্থীসহ নিহত হন ৪৫ জন। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে উঠলে আঁতকে ওঠেন নিহতের স্বজনরা। এখনও যাওয়া-আসার পথে দুর্ঘটনাস্থলে থমকে দাঁড়ায় মানুষ।
প্রতিবছরের মতো এবারও নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি।
২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই উপজেলা স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল জিতে একটি মিনি ট্রাকে করে ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের মধ্যখানে একটি ডোবায় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ২ জন, প্রফেসর কামালউদ্দিন চৌধুরী কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী ছিল। এছাড়া একজন অভিভাবক ও দু’জন ফুটবলপ্রেমীও মারা যান। এক অভিভাবক, ২জন ফুটবলপ্রেমী যুবকসহ ৪৫ জনের মৃত্যু হয় এ ঘটনায়।
নিহত ছাত্রদের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে সেসময় ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম এইচএম এরশাদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দৌজা চৌধুরীসহ দেশের বিশিষ্টজনরা।
দুর্ঘটনার কথা মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো মায়েরা। এ কান্নার শেষ কোথায় জানে না কেউই।হারানো সন্তানদের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে বাবা-মায়েদের কাঁদতে দেখা যায় প্রতিবছরই।
ট্র্যাজেডিতে সন্তান হারানোদের একজন নিহত রায়হান উদ্দিনের মা কোহিনুর বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার এখনও বিশ্বাস হয় না আমার ছেলে নেই। এইতো সেদিন রায়হান খেলা দেখতে বের হয়েছিল, সে ফিরে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে আমার ছেলে ৭ম শ্রেণিতে পড়তো। এতদিনে সে ডিগ্রি পাস করার কথা।’
কথা হয় ট্র্যাজেডি থেকে বেঁচে ফেরা তৎকালীন ৯ম শ্রেণী পড়ুয়া সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা খেলায় জেতার খুশিতে এতোটাই বিমোহিত ছিলাম যে, কখন আমরা রাস্তার পাশে খাদের পানিতে পড়ে ট্রাকচাপা পড়েছি কিছুই বলতে পারব না। শুধু দেখছিলাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকি। আমার মতো অন্যরাও চেষ্টা করেছে। একটা সময় আমি বের হতে পারি। অন্যরা পানির ভেতর থেকে টানাটানি করে আমার হাত-পা নখ দিয়ে কেটে ফেলেছিল।’
মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত হওয়া তৎকালীন ৮ম শ্রেণির ছাত্র আমিন শরীফের বাবা শাহজাহান বলেন, ‘আমার ছেলে যখন মারা যায় আমি তখন বিদেশে ছিলাম। শেষ সময়ে ছেলেটাকে আমি দেখিনি। এরচেয়ে কষ্টের আমার কাছে আর কিছুই নেই। আমার ছেলেসহ ৪৫ জন যেখানে নিহত হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে ‘অন্তিম’ নামের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যখনই ওই রাস্তা দিয়ে যায়, সেটা নজরে পড়ে। কষ্টে তখন বুকটা ফেটে যেতে চায়।’
নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। যেটি নির্মাণ করেন নিজাম মিস্ত্রি নামের এক ব্যক্তি। তার ছেলেও নিহত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে। বুকে কষ্ট চেপে পরম ভালোবাসায় নির্মাণ করেছেন স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যায়নি। সে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকবে মানুষের আবেগ হয়ে।’
আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল হোসেন বাবুল বলেন, ‘গত দু’বছর করোনা মহামারীর কারণে বড় কোনো কর্মসূচি হয়নি। তবে এ বছর সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় আমরা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সকালে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। নিহতদের স্মরণে আবেগ ও দুর্ঘটনাস্থলের অন্তিমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এরপর স্কুল প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন আইটি বিশেষজ্ঞ মাহবুব রহমান রুহেল।’
ডিজে