ম্যাক্সের ফাঁকিবাজিতে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সড়কের ৮ কিলোমিটারজুড়ে ধুলোর দুর্যোগ
লাখ লাখ মানুষ অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে ‘ফাটলের’ ঘটনায় সমালোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের খেয়ালখুশির নির্মাণকাজে চট্টগ্রামের প্রধান বিমানবন্দর সড়কের চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষ অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন প্রতিদিনই। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠলেও অদৃশ্য খুঁটির জোরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কোনো কিছুকেই পরোয়া করছে না।
চট্টগ্রামের প্রধান বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে কয়েক লাখ মানুষ। প্রায় তিন বছর আগে শুরু হয় লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ। প্রায় ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ফ্লাইওভারটি নির্মাণকালে পুরো বর্ষাজুড়ে পুরো সড়কের দুপাশে তৈরি হয় খানাখন্দ ও বড় বড় গর্ত। এতে নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। চলতি মাসের শুরুর দিকে শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে ওই সড়কে শুরু হয়েছে নতুন আপদ। সড়ক দিয়ে গাড়ি চলতেই ধুলোতে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ। প্রতিদিন এ ধুলোর দূষণের শিকার হচ্ছেন শহরের নারী-শিশু, বৃদ্ধ, কর্মব্যস্ত মানুষ ও সাধারণ পথচারী। অনাকাঙ্খিত এ ধুলোর দুর্যোগে ব্যাপকহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
‘লালখানবাজার টু বিমানবন্দর’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ। পাহাড়কাটাসহ বিভিন্ন ঘটনায় বিতর্কিত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে গত তিন বছর ধরেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ চলছে অস্বাভাবিক ধীরগতিতে। সরেজমিনে দেখা যায়, বড় বড় পিলারের জন্য উঠানো গর্তের মাটিগুলো সড়কেই পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ইপিজেড-সল্টগোলা ক্রসিং, আগ্রাবাদ এলাকায় ফ্লাইওভারের অধিকাংশ পিলারের কাজ শেষ হলেও সড়কের খানাখন্দ, মাটির স্তুপ ও ম্যাক্স গ্রুপের নির্মাণসামগ্রী থেকে যানবাহনের চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে অস্বাভাবিক ধুলো। সড়ক দিয়ে প্রতিটি যানবাহন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধুলোয় ভরে যাচ্ছে পথচারীদের পোশাক ও শরীর। ধুলোর এই দূষণ থেকে বাঁচতে অনেকেই নাকে হাত বা রুমাল দিয়ে চেপে ধরছেন।
পথচারীরাই শুধু নয়, প্রতিদিন ধুলোর দুর্যোগে ঢেকে পড়ছে সড়কের আশপাশের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, খাবারের হোটেল, ফুটপাতের দোকানপাট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বাসা-বাড়ির আসবাবপত্র। একইসঙ্গে সেখানে বাড়ছে নানারকম সংক্রমণ।
চট্টগ্রামে এই প্রথম প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সিইপিজেড থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত পিলারের কাজ শেষ হওয়ার পরও সেখানে পড়ে থাকছে গর্তের মাটির বিশাল বিশাল স্তূপ। পিলারের কাজ শেষ হওয়ার পরও এসব স্থানে সড়কের সংস্কার করা হচ্ছে না। আবার পিলারের কাজ শেষ হওয়ার আগেই অন্য স্থানে খোঁড়াখুড়ি ও সড়কে নিয়মিত পানি না ছিটানোর কারণে ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে ধুলোর দুর্যোগ।
ব্র্যাক ব্যাংক জুবলী রোড শাখার ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান থাকেন নেভী হাসপাতাল গেইট এলাকায়। তিনি বললেন, প্রতিদিন মোটরসাইকেল চড়ে অফিসে করছি। ফ্লাইওভার নির্মাণের নামে মানুষকে এভাবে দুর্ভোগে ফেলার কোনো অধিকার নেই ঠিকাদার ম্যাক্স গ্রুপের। ইপিজেড থেকে সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় অধিকাংশ ফ্লাইওভার পিলারের কাজ শেষ হয়েছে বর্ষার আগে। কিন্তু সেখানে তাদের কারণে পুরো রাস্তা ভরে গেছে খানাখন্দ ও বড়বড় গর্তে। এখন শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে সড়কের অসহনীয় ধুলো। যে কাপড়-চোপড় পরে বাসা থেকে বের হই, অফিসে পৌঁছার পর ধুলোর কারণে সেটা আর পরা যায় না।
আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা আকিব উদ্দিন প্রতিদিন বাসা থেকে অফিস করেন লালদিঘি এলাকায়। তিনি বলেন, প্রতিদিন অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই সড়কের ধুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে। রাস্তায় অতিরিক্ত ধুলোর কারণে মাস্কও কাজ করে না। গণপরিবহন চলার সময় জানালা খোলা থাকায় ধুলোয় ঢেকে যায় পরনের কাপড়-ছোপড়। প্রতিদিন এসব যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে অফিস করছি।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, গত বছরের শুরুতে ইপিজেড এলাকায় পিলার নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেখানে খানাখন্দ তৈরি হতে হতে এখন পুরো সড়ক বিশাল বিশাল গর্তে ভরে গেছে। এ কারণে অধিকাংশ গাড়ির চালক ইপিজেড থেকে সল্টগোলা ক্রসিং বিমানবন্দর সড়কটিতে যেতে চায় না।
তারা বলেন, বর্ষা শেষ হতে না হতেই এখন চলছে ধুলোর রাজত্ব। ধুলোর কারণে খাবারের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন ক্রেতাশূন্য। যেখানে ঘন্টায় হাজার টাকা বিক্রি হতো, সেখানে সারাদিনে ফুটপাতের এক থেকে দেড় হাজার টাকা বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধুলোর দূষণের কারণে মানুষের শরীরে নানা রকম সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে শ্বাসকষ্ট, যক্ষা, হাঁপানি, চোখের সমস্যাসহ ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেনের ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স র্যানকিন জেবি ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫৬ লাখ ১২ হাজার ১১৩ টাকায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু করে। ফ্লাইওভার প্রকল্পটিতে ৩৫ থেকে ৪৫ মিটার পর পর প্রতিটি পিলার বসার কথা রয়েছে। সেই হিসেবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোট পিলার বসবে ৪৫০টি।
ধুলোর দূষণ নিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ইপিজেড থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে কিছু জায়গায় সড়কের পানি ছিটানো হচ্ছে। সেখানে এতো ধুলো যে, পানি ছিটিয়েও সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না। সড়কজুড়ে খানাখন্দ ও গর্ত ভরাটের জন্য শিগগিরই কার্পেটিং করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কার্পেটিং হয়ে গেলে আশা করি আর ধুলো থাকবে না।
তবে সচেতনমহল বারবারই বলে আসছেন, সিডিএ ও ম্যাক্স গ্রুপ গত কয়েক বছর ধরেই আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। জনদুর্ভোগ কমানোর আগ্রহও নেই তাদের। মাঝখানে বিপুল টাকা বরাদ্দ দিয়েও দুর্নাম হচ্ছে সরকারের।
এদিকে ম্যাক্স গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইব্রাহিম খলিল পলাশ দাবি করেছেন, ‘ওই সড়কে প্রতিদিন চারটি গাড়ি সারাদিন পানি ছিটাচ্ছে। এছাড়া মাটির স্তুপ থাকার বিষয়টিও সত্যি নয়। কারণ মাটি সরাসরি ট্রাকে লোড হয়, পাশে কোথাও রাখা হয় না।’
তিনি বলেন, ‘পিলারের কাজ শেষ হওয়ার পরও রাস্তার কাজ বাকি থাকার অভিযোগও পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ কাজ শেষ হলে রাস্তা সমান করতে একটু সময় লাগে— এটা নিয়মিত কাজের অংশ। সময়মতো সব কাজ শেষ করেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
সিপি