সাতকানিয়ার ভোটে নৌকার প্রার্থীদের ‘মনের ভরসা’ পুলিশ, ৪ ইউনিয়ন চরম ঝুঁকিতে
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পেশীশক্তির জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা— এমন অভিযোগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনে তারা ব্যবহার করতে চাইছেন পুলিশ ও প্রশাসনকে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, হামলা, মারধর ও আতংক তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মনোনীত কয়েকজন প্রার্থী তাদের সহিংস মনোভাব জানান দিয়েছেন। ইতোমধ্যে কেন্দ্রে জোর খাটিয়ে ব্যালট নিয়ে ভোট নেওয়ার চিন্তাভাবনাও করছেন তারা। এক্ষেত্রে ‘মনে মনে’ তাদের ভরসা একমাত্র পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সকলেরই দাবি— ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ। ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নির্বিঘ্ন রাখতে তারা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন।
অন্যদিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করেছেন। প্রায় দেড় হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি’র পর্যাপ্ত উপস্থিতি থাকবে। পুলিশের পক্ষ থেকে ভোটারদের নির্বিগ্নে কেন্দ্রে যাওয়া-আসার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশ সুপার রশিদুল হক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রার্থীদের মধ্যে যারা সহিংসতার চিন্তা করছেন তারা এমন কিছু করতে চাইলেই আইনের আওতায় চলে আসবেন। ইতোমধ্যে কয়েকজন প্রার্থীকে ‘মেসেজ’ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখলে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়ার নির্দেশনাও রয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে নৌকার প্রার্থীরা পুলিশের কাছে আবদার করছেন বেশি। তাদের বেশিরভাগেরই আবদার আবার অনৈতিক। কেউ চাইছেন আধা ঘণ্টা সময়, কেউ বা এক ঘণ্টা। এই সময় দিলে জোর খাটিয়ে ব্যালটে সিল মেরে নিতে পারবেন তারা।
আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ছুটছেন পুলিশের কাছে। তাদের অনেকেরই আবদার সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। পুলিশও এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিতের কথা বলে আসছে। তবে পুলিশের এই কথার সঙ্গে কাজের মিল বুঝে নিতে অপেক্ষা করতে হবে সোমবার ভোট গণনা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
জানা গেছে, সোমবার সকাল ৮টা থেকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সহিংসতার সর্বোচ্চ আশংকা মাথায় রেখে প্রায় ১৫০০ হাজার পুলিশ মোতায়েন হয়েছে এই উপজেলায়। ছয় জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ভোট গ্রহণ আয়োজন সম্পন্ন করতে উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার রশিদুল হক।
এর মধ্যে ধর্মপুর, পুরানগড়, বাজালিয়া ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. আফরজুল হক টুটুল। চরতী, আমিলাইশ ও নলুয়া ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মো. জাহাঙ্গীর, খাগরিয়া ও কালিয়াইশ ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) সুজন চন্দ্র সরকার, কাঞ্চনা, মাদার্শা ও সোনাকানিয়া ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) শিবলী নোমান, ঢেমশা ও পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নে সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) মো. হুমায়ুন কবির, ছদাহা, কেওচিয়া ও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করবেন সহকারী পুলিশ সুপার (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে সোনাকানিয়া, খাগরিয়া, বাজালিয়া ও ধর্মপুর ইউনিয়নকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরে নেওয়া হয়েছে। এসব ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থা সার্বক্ষণিক মোতায়েন রাখা হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের আগের দিন রোববার বিকেলেও খাগরিয়ায় বহিরাগত প্রবেশ ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ এর আগে ২৭ জানুয়ারি নৌকা প্রার্থী আক্তার হোসেন ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিনের গণসংযোগে ১৫ জনকে গুলি করার অভিযোগ উঠে। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারী নিজ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দুইটি অস্ত্র লোড রাখার ঘোষণা দিতে দেখা যায় আক্তার হোসেনকে।
৪ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিম চৌধুরীর ঘরে উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালায়। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর আগে ২৪ জানুয়ারি সোনাকানিয়া ইউনিয়নের বদর সিকদারপাড়া পূর্ব গারাঙ্গিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় সেলিম চৌধুরীর সমর্থকদের ২০টি গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠে নৌকার প্রার্থী জসিমের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে নলুয়া ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমানের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। প্রতীক বরাদ্দের দিনেই সাতকানিয়া উপজেলা চত্বরের বিআরডিবি ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমান ও তার ভাই শাহজাহান চৌধুরীসহ আহত হয়েছেন ৬ জন। এছাড়া অপহরণ করে মারধরের অভিযোগও উঠেছে তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
খাগরিয়ার স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আক্তার হোসেন নৌকা প্রতীক পেয়ে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে, হামলা চালিয়ে পুলিশনির্ভর একটি ভোট করার চিন্তা করেছেন। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পুলিশ আক্তারের কথায় অন্যায় তেমন কিছু রোববার পর্যন্ত করেনি।’
সোনাকানিয়ার স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিম চৌধুরী বলেন, ‘নৌকা প্রতীক এনে সোনাকানিয়ায় এনে তারা সহিংসতানির্ভর নির্বাচন করতে চেয়েছে। ভাঙচুর ও হামলা চালিয়ে একের পর এক আতংক সৃষ্টি করতে চেয়েছে। পুলিশকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছে। নির্বাচনের দিন যদি পুলিশ নিরপেক্ষ থাকে তাহলে জনগণ ভোট দিতে পারবে। আর না হয় ভোট লুটের আশংকা রয়েছে।’
সিপি