ইংরেজিই ডোবালো চট্টগ্রামের ৩১ হাজার এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে, কোচিং-মোবাইলকে দুষছেন শিক্ষকরা
চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল
উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবার পাশের হার ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৮৮৮ জন। এমন ফলাফল বিপর্যয়ে পাশ করা পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ফেল করা পরীক্ষার্থীদের ব্যবধান মাত্র ৫ হাজার ২৩২ জন। ইংরেজিসহ চার বিষয়ে ফেল বেশি করায় সামগ্রিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।
এবারের ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে ‘রুব্রিক্স ম্যাথড’, এআই নির্ভরতা, শিক্ষক ঘাটতি, পাঠ্যবই না পড়াসহ বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে।
শিক্ষকরা বলছেন, পরীক্ষার খাতায় যতটুকু বা যেরকম লিখেছে, মূল্যায়নের পর সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে গড় রেজাল্টে। এছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং দক্ষ শিক্ষক ঘাটতিও বড় একটা বিষয়। শিক্ষার্থীরা মোবাইলের অতিরিক্ত আসক্ত, মনোযোগে ঘাটতির কারণে ফলাফল খারাপ হতে পারে। একইসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ রাজনৈতিক প্লাটফর্মে জড়িয়ে যাওয়ায় পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হতো না। গ্রেস মার্কিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভালো দেখানো হতো। ফলে এখন সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসায় এমন ফলাফলের দেখা মিলছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবারের ১ লাখ ১ হাজার ৮৮৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৫৩ হাজার ৫৬০ জন, ফেল করেছে ৪৮ হাজার ৩২৮ জন। পাশ আর ফেলের ব্যবধান ৫ হাজার ২৩২ জন।
অথচ ২০২৩ সালে পাশের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এবার পরীক্ষার্থীরা ইংরেজি, পদার্থ বিদ্যা, পৌরনীতি, আইসিটিতে ফেল বেশি করেছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ইংরেজিতেই ফেল করেছে ৩১ হাজার ৪৬২ জন। পৌরনীতিতে ১৩ হাজার ৫৪২ জন, আইসিটিতে ১৪ হাজার ২২৬ জন এবং পদার্থ বিদ্যায় ২ হাজার ৮৫৫ জন ফেল করেছে।
উচ্চতর গণিতে ৭৮ দশমিক ২০ শতাংশ এবং হিসাব বিজ্ঞানে ৭৮ দশমিক ০৯ শতাংশ পাশের হারের কারণে অনেকের জিপিএ-৫ হাতছাড়া হয়েছে। এছাড়া বাংলায় পাশের হার ৮৮ শতাংশের বেশি হলেও ফেল করেছে ১০ হাজার ১০০ জন।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এ পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রুব্রিক্স বা প্রতিবর্ণীকরণ পদ্ধতি ফলো করায় নম্বর কমে গেছে শিক্ষার্থীদের। খাতায় নম্বর বণ্টনে অযথা নম্বর দেওয়া হয়নি। রুব্রিক্স হল কোনো কাজ বা প্যারফরম্যান্সের মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সাধারণত কোনো শিক্ষক বা খাতা মূল্যায়নকারী এই রুব্রিক্স ব্যবহার করে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প বা পরীক্ষার মূল্যায়ন করে থাকেন। যেমন একটা টপিকে কোথায় কত নম্বর দিতে হবে, তা উল্লেখ করা থাকে রুব্রিক্সে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলাফল খারাপ হওয়ার পেছনে কোচিং সেন্টারও একটা বড় কারণ। কোচিংয়ে মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার বদৌলতে শিট দিয়ে মুখস্থ করানো হয়। যার প্রভাব পড়ছে ফলাফলে।’
পরীক্ষার্থীদের দাবি, ফলাফল খারাপ হওয়ার পেছনে প্রশ্নের জটিলতাও দায়ী।
পটিয়া সরকারি কলেজের মাহনাফ নামে একজন পরীক্ষার্থী জানান, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ইংরেজি প্রশ্নপত্র জটিল ছিল। ইংরেজি প্রশ্নপত্রে প্যারাগ্রাফ অনেকেই লিখতে পারেনি। তারা যে ধরনের প্যারাগ্রাফ পড়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছিল, সেরকম প্যারাগ্রাফ আসেনি। এমসিকিউ জটিল ছিল। প্যারাগ্রাফের ১৫ নম্বর অনেকেরই বাদ পড়ে গেছে।
সুবাইদাহ নামে আরেক পরীক্ষার্থী জানান, আইসিটি পুরোটাই কঠিন ছিল। প্রশ্ন ঘুরায়-পেচায় দিয়েছে। এর এমসিকিউ কঠিন ছিল। আইসিটিতে শিক্ষার্থীরা ১ম চ্যাপ্টার সহজ থাকায় সেটাই আত্মস্থ করেছিল। কিন্তু ২য় চ্যাপ্টার জটিল ছিল। সেখান থেকেই প্রশ্ন বেশি এসেছে পরীক্ষায়।
এদিকে বাংলায় পরীক্ষার্থীরা আশানুরূপ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। এ বিষয়ে পাসের হার ৮৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ হলেও ফেল করেছে ১১ হাজার ৮৭০ জন।
এর কারণ হিসেবে শিক্ষকরা বলছেন, বাংলা মাতৃভাষা হওয়ায় এটিকে শিক্ষার্থীরা সহজ মনে করে। মনে করে, যেভাবে হোক, প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসতে পারবেই। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় ভালো করতে হলে, প্রশ্নের ধরন বুঝে অনুশীলন করতে হবে। এইচএসসিতে ব্যাকরণ, সারাংশ, অনুবাদ কিংবা দিনলিপি—সবকিছুতেই প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে চর্চা করলে নম্বর তোলার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকত। যা করেনি পরীক্ষার্থীরা।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—শিক্ষক সংকট, প্রয়োজনীয় ল্যাব ও অবকাঠামোর অভাব এবং দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা।
ডিজে