সূরা ইয়াসিন—কুরআনের হৃদয়, মুমিনের শান্তির উৎস

সূরা ইয়াসিনকে বলা হয় ‘পবিত্র কুরআনের হৃদয়’। কুরআনুল কারিমে ৩০টি পারা বা জুজ রয়েছে। সূরা ইয়াসিন ২২তম পারার শেষ দিকে শুরু হয়ে ২৩তম পারার প্রথম দিকে শেষ হয়েছে। এতে রয়েছে ৮৩টি আয়াত, পাঁচটি রুকু ও সাতটি ‘মুবিন’। তাফসীরকারকরা কেন এটিকে কুরআনের হৃদয় বলা হয়—তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ করেছেন। সুরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ, নবুওয়ত, পরকাল ও পুনরুত্থানের বিষয়গুলো গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

সূরা ইয়াসিনের ফজিলত

হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুরই একটি হৃদয় থাকে, আর কুরআনের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন একবার পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে পুরো কুরআন দশবার পড়ার সওয়াব দান করবেন।’
অন্য হাদিসে এসেছে—‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, তার জন্য থাকবে মাগফিরাত।’

সূরা ইয়াসিন মানুষকে পরকালের প্রস্তুতির দিকে আহ্বান জানায়। এই চিন্তাই মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে ও হারাম কাজ থেকে দূরে রাখে। যেমন শারীরিক সুস্থতা নির্ভর করে হৃদয়ের স্বাস্থ্যের ওপর, তেমনি ঈমানের দৃঢ়তা নির্ভর করে পরকালের চিন্তার ওপর। এ কারণে সুরা ইয়াসিন পাঠকারীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ সন্তুষ্টি বর্ষিত হয়।

গোনাহ মাফের মাধ্যম

মানুষ প্রতিদিন নানান গোনাহ করে, সচেতনভাবে বা অজান্তে। এসব গোনাহ মানুষকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়। গোনাহ থেকে মুক্তির অন্যতম পথ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নেক আমল করা।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওই রাতের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’
অন্য বর্ণনায় হজরত ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’

দুনিয়াবি কল্যাণ ও রিজিকের বরকত

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ অভাব-অনটনের সময় সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ তার অভাব দূর করবেন, সংসারে শান্তি আনবেন ও রিজিকে বরকত দেবেন।’
আতা বিন আবি রাবাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনের বেলায় সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তার সব প্রয়োজন পূর্ণ করবেন।’
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত—‘যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ কবরবাসীর আজাব হালকা করে দেন এবং পাঠকারীর জন্য সওয়াব লিখে দেন।’

মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির মাধ্যম

তাফসিরে জালালাইন অনুযায়ী, যদি কোনো মুসলমান মৃত্যুর সময় সূরা ইয়াসিন পাঠ করা হয়, তবে বেহেশতের ফেরেশতা রিদওয়ান জান্নাতের সুসংবাদ না দেওয়া পর্যন্ত মলাকুল মাউত তার রূহ কবজ করেন না।
হজরত আবু যর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মৃত্যুশয্যায় কারও পাশে সূরা ইয়াসিন পাঠ করলে তার মৃত্যু সহজ হয়।’
ইবনে ইয়াসার (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা মৃত্যুর সময় প্রিয়জনদের পাশে সূরা ইয়াসিন পাঠ কর।’

অভাবমুক্ত থাকার আমল

মানুষের জীবনে অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট অবিচ্ছেদ্য। কেবল পরিশ্রমে সব পূর্ণ হয় না; প্রয়োজন হয় আল্লাহর রহমতের। সূরা ইয়াসিন পাঠ সেই রহমতেরই অন্যতম দরজা।
হজরত ইয়াহইয়া ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে থাকবে; আর যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে, সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে।’

ঘরে ঘরে সূরা ইয়াসিনের অধ্যয়ন

মুমিন মুসলমানের ঘরে সূরা ইয়াসিনের নিয়মিত তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন হওয়া উচিত। সুরাটির অন্য কয়েকটি নামও রয়েছে—‘সুরা আজিমা’, ‘সুরা মুদাফিয়া’ ও ‘সুরা কাজিয়া’। তাওরাতে একে বলা হয়েছে ‘মুয়িম্মাহ’।
এক হাদিসে এসেছে—‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে, আল্লাহ তার সারা দিনের প্রয়োজন পূর্ণ করবেন এবং সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।’ অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে—‘যে রাতে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে, সে নিষ্পাপ অবস্থায় ঘুম থেকে উঠবে।’

কেয়ামতের দিনে সুপারিশ

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর একটি হৃদয় আছে, আর কুরআনের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি এটি একবার পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে দশবার কুরআন পাঠের সওয়াব দেবেন।’
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘সূরা ইয়াসিন কেয়ামতের দিন তার পাঠকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে, আর আল্লাহ সেই সুপারিশ কবুল করবেন।’

উপসংহার

সূরা ইয়াসিন পাঠের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে, হৃদয়ে প্রশান্তি আসে, রিজিকে বরকত হয় ও মৃত্যুর সময় সহজ হয়। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর এই সুরাটি তেলাওয়াত করা ঈমান মজবুত রাখে, জীবনে শান্তি আনে এবং পরকালের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে এই ফজিলতপূর্ণ সুরাটির নিয়মিত তেলাওয়াত, অধ্যয়ন ও তা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

ksrm