চট্টগ্রামে সাতটি পোশাক কারখানা একসঙ্গে বন্ধ, ‘বাইরের ইন্ধনে’ ৩৫ হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তায়

কারখানায় মারামারি থেকে লকডাউন

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) কর্মরত ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ’ বৃহস্পতিবার এক ঘোষণায় জানিয়েছে, শ্রমিকদের সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অনুকূল কর্মপরিবেশ না থাকায় তাদের সাতটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে বাইরে থেকে শ্রমিকদের কোনো ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটি তদন্ত করছে পুলিশ।

চট্টগ্রামে সাতটি পোশাক কারখানা একসঙ্গে বন্ধ, ‘বাইরের ইন্ধনে’ ৩৫ হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তায় 1

সংঘর্ষ থেকে বন্ধ ঘোষণা

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিগুলোতে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের স্বাক্ষর ছিল।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে কিছু শ্রমিক কাজ বন্ধ রেখে মারামারি, ভাঙচুর ও লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। এতে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক—সব পক্ষের মানুষ আহত হন।

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই পরিস্থিতিতে কারখানার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি শ্রম আইনের দৃষ্টিতে ‘অবৈধ ধর্মঘট’ হিসেবে গণ্য হওয়ায়, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (ধারা ১৩-ক) অনুযায়ী কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

যে সাত কারখানা বন্ধ

সিইপিজেড এলাকায় প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের যে সাতটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো হলো— প্যাসিফিক জিনস, জিনস ২০০০, ইউনিভার্সেল জিনস, এনএইচটি ফ্যাশন, প্যাসিফিক এক্সেসরিজ, প্যাসিফিক ওয়ার্কওয়্যার এবং প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স।

এর মধ্যে প্যাসিফিক জিনসের দুটি ইউনিট ও ইউনিভার্সেল জিনসের চারটি ইউনিট রয়েছে।

পুলিশের তদন্ত ও আশঙ্কা

চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কারখানা বন্ধের চিঠি পেয়েছি। শ্রমিকদের মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আছে। তবে বাইরে থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কি না, সেটি আমরা তদন্ত করছি।’

তিনি আরও জানান, কারখানা বন্ধের ঘোষণা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত, এবং এটি মালিকপক্ষের অধিকার। যত দিন কারখানা বন্ধ থাকবে, শ্রমিকেরা তত দিন কোনো বেতন পাবেন না।

পূর্ববর্তী উত্তেজনার ইতিহাস

প্যাসিফিক জিনস গ্রুপে শ্রমিক অস্থিরতা নতুন নয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও একই ধরনের ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ক্যাজুয়েলস লিমিটেডের দুটি ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন।

এরও আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ইপিজেডের ভেতরে শিল্প পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করলেও আজও কোনো গ্রেপ্তার হয়নি। শ্রমিকদের একাংশের অভিযোগ, ‘মামলার মাধ্যমে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে।’

বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষ

বৃহস্পতিবার সকালেই প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এনএইচটি ফ্যাশনসের সামনে শ্রমিকদের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে অন্তত ৭ জন আহত হন এবং শিল্প পুলিশের পাহারায় তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শ্রমিকদের এক পক্ষ অভিযোগ করেছে, ‘কারখানার কর্মকর্তারা আমাদের মারধর করেছে।’ অপরদিকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘কিছু শ্রমিক ইচ্ছাকৃতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’

৩৫ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে

প্যাসিফিক জিনস গ্রুপে বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। এই কারখানাগুলোর হঠাৎ বন্ধ ঘোষণা শ্রমিকদের জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, তারা হঠাৎ করেই কোনো লিখিত নোটিশ ছাড়াই কারখানায় ঢুকতে পারেননি।

একজন নারী শ্রমিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে কাজে যেতে গিয়ে দেখি গেটে তালা। কেউ কিছু জানায়নি। এখন আমরা কোথায় যাব?’

পোশাকশিল্পে অস্থিরতার নতুন ইঙ্গিত

চট্টগ্রামের সিইপিজেড দেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিমুখী শিল্পাঞ্চল। সেখানে টানা সংঘর্ষ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে। শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বহু বছর ধরে সফলভাবে রপ্তানি করা প্যাসিফিক জিনসের মতো গ্রুপে বারবার অস্থিরতা দেখা দিলে তা দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

এ বিষয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

ksrm