চট্টগ্রাম রেড ক্রিসেন্টের যুব ক্যাম্পে নারী হেনস্তা, অভিযোগের পরও উল্টো হুমকি

কমিটি হলেও শুরু হয়নি তদন্ত, ফুটেজ মুছে ফেলার অভিযোগ

চট্টগ্রাম সিটি রেড ক্রিসেন্টের চার দিনের যুব ক্যাম্পে এক নারী যুব সদস্যকে নির্বাহী কমিটি (ইসি) কমিটির সদস্য এইচএম সালাহউদ্দিন জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে হেনস্তার অভিযোগ তুলতেই পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়। অভিযোগ জানানোর পরও তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ভুক্তভোগী ও তার পাশে থাকা দুই নারীকে চুপ থাকতে বলা হয়। ক্যাম্পে থাকা সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলার অভিযোগ, তদন্ত শুরু না হওয়া, নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এবং ওই ঘটনার পর থেকে নারী স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার তথ্য—ঘটনাটিকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি গড়িয়েছে কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত। তবে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও কাজই এখনও শুরু করা যায়নি।

চট্টগ্রাম সিটি রেড ক্রিসেন্টের ইসি কমিটির সদস্য এইচএম সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে একজন নারী সদস্যকে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পর বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করেছেন বলে যুবপ্রধান আ ন ম তামজীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে সংগঠনের একাধিক সদস্য।
চট্টগ্রাম সিটি রেড ক্রিসেন্টের ইসি কমিটির সদস্য এইচএম সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে একজন নারী সদস্যকে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পর বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করেছেন বলে যুবপ্রধান আ ন ম তামজীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে সংগঠনের একাধিক সদস্য।

জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটলেও দীর্ঘ সময় ধরে সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। পরে গত ১৪ অক্টোবর ঘটনার শিকার নারী রেড ক্রিসেন্টের সদর দপ্তরে অভিযোগ জানানোর পর ঘটনাটি জানাজানি হয়।

রেড ক্রিসেন্ট সদর দপ্তর থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের এক সপ্তাহ পার হলেও কমিটি এখনও কাজই শুরু করেনি।
রেড ক্রিসেন্ট সদর দপ্তর থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের এক সপ্তাহ পার হলেও কমিটি এখনও কাজই শুরু করেনি।

ক্যাম্পের ভেতরে হেনস্তার অভিযোগ

২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে আয়োজিত যুব ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিনে ইসি কমিটির সদস্য এইচএম সালাহউদ্দিন এক নারী যুব সদস্যকে জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে হেনস্তার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনাটি ঘটার পর হতবিহ্বল ওই তরুণী দ্রুত সরে যান। পরে তিনি যুবপ্রধান আ ন ম তামজীদসহ সিনিয়র যুব সদস্যদের বিষয়টি জানান। তারা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু ক্যাম্প শেষে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ভুক্তভোগী ও তার সঙ্গে থাকা দুই নারীকে বলা হয় ঘটনাটি বাইরে না নিতে। এই ঘটনার পর থেকে যুব রেড ক্রিসেন্টে নারী স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ কমেছে বলে সংগঠন–সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী তরুণী চট্টগ্রামের একটি কলেজে অনার্সে পড়ছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে আয়োজিত হয় যুব ক্যাম্প।
গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে আয়োজিত হয় যুব ক্যাম্প।

যুব রেড ক্রিসেন্টের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি অনেকে জানতেন। অভিযোগ রয়েছে, একজন শীর্ষ কর্মকর্তা অভিযুক্তের পক্ষ নিয়েছেন। ওই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ মিলেছে।

ওই ক্যাম্পে অংশ নেয় চট্টগ্রামের ১৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় হাজার সদস্য।

তদন্ত কমিটি হলেও কাজ শুরু হয়নি

চট্টগ্রামের দায়িত্বশীলরা ব্যবস্থা না নেওয়ায় অভিযোগ যায় জাতীয় সদর দপ্তরে। সেখানে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। রেড ক্রিসেন্টের প্রশিক্ষণ ও যুব স্বেচ্ছাসেবক পরিচালক সাবিনা ইয়াসমিনকে আহ্বায়ক এবং ডিসিআরএম বিভাগের সিইএ ম্যানেজার আমিরুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। দুজনই বর্তমানে বান্দরবানে প্রশিক্ষণে আছেন বলে জানা গেছে।

গত ৬ নভেম্বর এইচআর ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এএসএম আক্তার স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, অভিযোগকারী ও সাক্ষীর পরিচয় সুরক্ষিত রেখে তদন্ত শেষে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন মহাসচিবকে জমা দিতে হবে।

জানা গেছে, তদন্ত কমিটি গঠনের এক সপ্তাহ পার হলেও কমিটি এখনও কাজই শুরু করেনি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সাবিনা ইয়াসমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বাইরে আছি। তাই কাজ শুরু করা যায়নি।’

এদিকে এই আদেশ জারির পর যুবপ্রধান আ ন ম তামজীদ ও অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন নতুনভাবে তৎপর হন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

রাজনৈতিক প্রভাবের কথাও উঠেছে

জানা গেছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সিটি ইউনিটের নির্বাহী কমিটির সবাই বাদ যান। কেবল রয়ে যান সালাহউদ্দিন। তামজীদ ও সালাহউদ্দিন আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে তারা নিজেদের বিএনপি নেতাদের কাছে ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে প্রভাব দেখানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীর বক্তব্য

ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, ‘বুলেটিন প্রচার হচ্ছিল। আমি দেখছিলাম। ইসি মেম্বার সালাহউদ্দিন এসে ক্যাম্প কেমন হচ্ছে জিজ্ঞেস করেন। কথা বলতে বলতেই উনি আমার খুব কাছে চলে আসেন। পরে দেখি দুই হাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার ইঙ্গিত করছেন। হঠাৎ করে সজোরে জড়িয়ে ধরেন। আমি স্থির হয়ে যাই। পরে ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি চৈতী বড়ুয়াকে জানাই।’

এক প্রত্যক্ষদর্শী নারী বলেন, ‘দীপ্ত ভট্টাচার্য্য ও রকিবুল ইসলামকে সব বললে তারা যুবপ্রধান তামজীদকে ফোন করেন। পরে যুবপ্রধান এসে ভুক্তভোগীকে ডেকে ঘটনা জানতে চান।’

ভুক্তভোগী তরুণীর ভাষ্য, ‘তামজীদ ভাই আমাদের পাশে বসিয়ে ঘটনার কথা শোনেন। পরে ব্যক্তিগত নানা প্রশ্ন করেন। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এটা গুড টাচ না ব্যাড টাচ।’

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নারী বলেন, ‘তামজীদ বলেন, উনি সিনিয়র, তাই এভাবে ধরতেই পারেন। আদর করে ধরছে।’

ভুক্তভোগী জানান, ক্যাম্প থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন যুবপ্রধান। ‘আমরা সিনিয়রদের জানিয়েছি’— এমন কথা শুনে তিনি কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করেন। তরুণীর অভিযোগ, ‘তিনি বারবার বলেন, ঘটনাটা চেপে যাও। নইলে ফ্যামিলিতে চলে যাবে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, অনেকেই ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন। তবু কেউ বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেখেননি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগও তোলা হয় যে তারা ক্যাম্প নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নাটক সাজিয়েছেন।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘সেক্রেটারি গোলাম বাকী মাসুদ ও আযম ভাইকে জানালে তারা ২৪ ঘণ্টা সময় চান সমাধানের জন্য।’

এ বিষয়ে সাবেক যুব প্রধান কাজী তৌফিকুল আযমের যোগাযোগ করা হলে, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, বিষয়টির একটি সুরাহা করার জন্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় আমরা সামনে এগোতে পারিনি।’

দায়িত্বশীলদের অবস্থান

চট্টগ্রাম সিটি রেড ক্রিসেন্টের সেক্রেটারি গোলাম বাকী মাসুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটি যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে, তারা দেখলেই নিরপেক্ষ তদন্ত হবে।’

যুবপ্রধান আ ন ম তামজীদ বলেন, ‘সমাধানের চেষ্টা করেছি। নানা কারণে পারিনি।’ হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

অভিযুক্ত এইচএম সালাহউদ্দিনের সঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও উত্তরে কিছু জানাননি।

বুধবার রাতে ভুক্তভোগীর ওই নারীর বাবা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি বিচার চাই। আমার মেয়েকে হেনস্তাকারীর শাস্তি চাই।’

সিপি

ksrm