ক্ষমতার লড়াই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে, মেয়র–সিইও বিরোধে এবার তদন্তে নামল সরকার

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনায় এবার তদন্তে নেমেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই বিরোধ ঘিরে প্রশাসনিক অচলাবস্থার অভিযোগ উঠলে মন্ত্রণালয় থেকে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি দুই সদস্যের

গত রোববার (৯ নভেম্বর) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সুরাইয়া আখতার জাহানকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপসচিব মো. ফিরোজ মাহমুদকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের দেওয়া সিইও বদলিপত্র, তৌহিদুল ইসলামের যোগদানপত্র ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পরীক্ষা করবে কমিটি। তবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।

বদলি প্রস্তাব ও অভিযোগপত্রের শুরু

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মেয়র শাহাদাত হোসেন গত ২ নভেম্বর সিইও শেখ তৌহিদুল ইসলামকে বদলির প্রস্তাব দেন। তার আগে ৩০ অক্টোবর তৌহিদুল ইসলাম স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে লিখিতভাবে জানান, ছুটি শেষে যোগ দিতে চাইলেও মেয়র তাকে দায়িত্ব গ্রহণের অনুমতি দেননি।

সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটির আদেশ আমরা পেয়েছি।’

দ্বন্দ্বের শুরু ও বিতর্কিত দায়িত্ব বণ্টন

প্রশিক্ষণ শেষে ২২ অক্টোবর অফিসে যোগ দিতে গেলে মেয়র শাহাদাত হোসেন সিইওর যোগদানপত্র গ্রহণ না করে সচিব আশরাফুল আমিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে মেয়রের এমন দায়িত্ব বণ্টন আইনি সীমা অতিক্রম করে। এটা মেয়রের এখতিয়ার বহির্ভূত।

এরপর গত শনিবার (৮ নভেম্বর) সকালে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে মেয়র শাহাদাত লন্ডনের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। সেখানে প্রায় ১৫ দিন থাকার কথা রয়েছে তার। অভিযোগ উঠেছে, তিনি আইনানুগভাবে কাউকে দায়িত্ব না দিয়েই বিদেশ সফরে গেছেন। এর আগেও গত ১ জুলাই ছেলের সঙ্গে সময় কাটাতে তিনি কানাডায় গিয়েছিলেন। ২৫ দিন পর দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তখনও কারও কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়নি, ফলে প্রশাসনিক কাজকর্মে জটিলতা তৈরি হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা ও নতুন বিতর্ক

বিদেশ সফরের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার পর মেয়র শাহাদাত লন্ডন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানান, ‘সফরের সময় সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক দায়িত্ব সচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আমিনের হাতে থাকবে।’

তবে সংশোধিত স্থানীয় সরকার আইন অনুসারে, মেয়র অনুপস্থিত থাকলে এবং প্যানেল মেয়র না থাকলে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র সরকার বা মন্ত্রণালয়ের। মেয়রের ব্যক্তিগতভাবে এমন নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ নেই। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়নি।

নোটিশ ও পাল্টা বক্তব্য

সফরে যাওয়ার আগেই মেয়র শাহাদাত এক অফিস আদেশে নির্দেশ দেন, সিইওর যোগদান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত সব নথি সচিবের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠাতে হবে। এরপর ২৭ অক্টোবর সিইও শেখ তৌহিদুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন তিনি। সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। অভিযোগ ছিল, দুটি প্রতিষ্ঠানের গৃহকর জালিয়াতি তদন্তে দায়িত্বে অবহেলা করেছেন তৌহিদুল ইসলাম। তাঁকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলেও সোমবার পর্যন্ত তা জমা পড়েনি।

তৌহিদুল ইসলাম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। পরে জানার পর অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং বারবার প্রতিবেদন চেয়েছি। তাই নোটিশ দেওয়াটা অযৌক্তিক।’

আচমকা আন্দোলন ও সিইওর অনুপস্থিতি

এর আগে গত ৩০ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল–সমর্থিত শ্রমিক–কর্মচারী ইউনিয়নের ব্যানারে সিইওর অপসারণের দাবিতে সিটি করপোরেশন কার্যালয় ঘেরাও করা হয়। তারও আগে একই দাবিতে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সময় থেকেই মেয়র ও সিইওর বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। এরপর থেকে তৌহিদুল ইসলাম অফিসে যাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

সিপি

ksrm