চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে প্রকাশ্যে অপহরণ করে রাউজানে জিম্মি, হাজার কোটির গুজব থেকে ঘটনা শুরু
চার ‘শিবিরকর্মী’ গ্রেপ্তার, উদ্ধার ভিকটিমও ছাত্রলীগ নেতা
চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ত পাঁচলাইশ এলাকার পার্কভিউ হাসপাতাল। রোববার (৯ নভেম্বর) রাত আটটা। চিকিৎসক দেখাতে আসা এক তরুণ হঠাৎ কয়েকজন অচেনা যুবকের হাতে পড়ে যান। মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালের চতুর্থ তলার নীরবতা ভাঙে চিৎকারে—চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি আর টানাহেঁচড়ার মধ্যে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যান হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং অফিসার ফয়সাল মাহমুদ। ঠিক হাসপাতালের ভেতর থেকেই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নিচে, অপেক্ষমাণ একটি হায়েস গাড়িতে তুলে ফেলে শহরের বাইরে অজানা গন্তব্যে।

এর পরের সময়টা যেন রহস্যের এক অন্ধকার অধ্যায়। মুক্তিপণ দাবি, নির্যাতন, ব্যাংক বুথে টাকা উত্তোলন—সব শেষে রাউজান থেকে উদ্ধার ফয়সাল। পুলিশ বলছে, এটি শুধু অপহরণ নয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর টাকার লোভ জড়ানো এক ভয়ঙ্কর চক্রের কাজ।

চট্টগ্রাম শহরের পার্কভিউ হাসপাতালের ভেতর থেকে ওষুধ কোম্পানির ওই মার্কেটিং সেলস অফিসারকে তুলে নিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে সোমবার (১০ নভেম্বর) চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে পাঁচলাইশ মডেল থানায়। অজ্ঞাত আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। অপহরণকারীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তবে পরবর্তীতে কেউ কেউ ‘আপ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে তুলে রাউজানে জিম্মি
মামলার বাদী কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মৈশাতুলা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিন (৬০)। তার ছেলে ফয়সাল মাহমুদ (৩০) হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মার্কেটিং সেলস অফিসার। তিনি চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী রোডে ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রোববার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ফয়সাল চিকিৎসকদের ভিজিট করতে পার্কভিউ হাসপাতালে যান। রাত আটটার দিকে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অবস্থানকালে চার-পাঁচজন যুবক হঠাৎ ঢুকে পড়ে। নিজেদের পরিচয় না দিয়ে তারা ফয়সালকে ‘অপরাধী’ বলে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মেরে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনে। এরপর তাকে একটি হায়েস গাড়িতে তুলে নেয়।
পুলিশের ভাষ্য, ফয়সালকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের রাউজানের গহিরা এলাকায়। সেখানে একটি পরিত্যক্ত ভবনে আটকে রেখে মারধর করা হয়।
এক হাজার কোটির গুজব, মুক্তিপণ দাবিতে নির্যাতন
সূত্র জানায়, অপহরণকারীদের ধারণা ছিল, ফয়সালের কাছে কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের এক হাজার কোটি টাকা রয়েছে। সেই গুজব থেকেই শুরুতে তারা ১০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে অঙ্কটা কমে দাঁড়ায় ২০ লাখ টাকায়। টাকা না দিলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
ভয়ে ফয়সাল নিজের কাছে থাকা দুই হাজার টাকা দেয়। পরদিন রোববার সকালে তাকে রাউজানের ডাচ–বাংলা ব্যাংকের বুথে নিয়ে গিয়ে ১৮ হাজার টাকা, এরপর জিইসি মোড়ের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বুথ থেকে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করানো হয়। মোট ৬০ হাজার টাকা আদায়ের পর ফয়সালকে চকবাজারের প্যারেড মাঠ এলাকায় এনে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানে তাকে ‘ছাত্রলীগের নেতা’ বলে মারধরও করা হয়।
চারজন নামীয় আসামি, সবাই চট্টগ্রাম অঞ্চলের
মামলায় আসামি করা হয়েছে রাউজানের হরিস খানপাড়ার মোহাম্মদ আবুল সাজ্জাদ ওরফে আদর (৩২), পশ্চিম রাউজানের বাইন্যা পুকুরপাড়ের আশরাফুল আমিন (২৯), লোহাগাড়ার চরম্বা এলাকার তারিক আসিফ (২৭) এবং কুমিল্লার নাথেরপেটুয়া গ্রামের শাহাদাত হোসেন শান্ত (২০)-কে। চারজনের বিরুদ্ধেই অপহরণ, চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগ আনা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তারা ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন ইউনিটে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে কেউ কেউ ‘আপ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হন। জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় কয়েকজন নেতা অপহরণের বিষয়টি জানতেন বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
ভিকটিমের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও তদন্ত
পুলিশ অনুসন্ধানে জানতে পারে, ফয়সাল মাহমুদ মনোহরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তবে গত অন্তত চার বছর ধরে তিনি ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সেলস অফিসার হিসেবে চট্টগ্রামে চাকরি করছিলেন। তিনি মূলত ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ বিপণন করেন।
ফয়সালের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, তিনি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন ও গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে— ‘হবো একদিন সবাই এক’, ‘ব্যাচ-১৩’, ‘জয় বাংলা’, ‘গোবিন্দপুর ছাত্রলীগ’, ‘লাকসাম মনোহরগঞ্জ আওয়ামী লীগ’, ‘বাইশগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘খিলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘আশিয়াদারী ছাত্রলীগ’, ‘বাঁচতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই’, ‘আমরা সবাই মুজিব সেনা’, ‘একতাই শক্তি’, ‘৬৪ জেলা ইউনিট আওয়ামী লীগ’, ‘ধানমন্ডি–৩২’, ‘মৈশাতুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘হাসনাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘ভাই ব্রাদার্স’, ‘মোস্ট পারসন’, ‘মানবতা আজ কোথায়’, ‘বীর মুজিব সেনারা’, ‘তৃণমূল ছাত্রলীগ কর্মী মনোহরগঞ্জ উপজেলা’, ‘যৌবনের প্রথম প্রেম বিএসএল’, ‘তৃণমূল কর্মী’, ‘ছাত্রসমাবেশ ঢাকা ১-৯-২৪’, ‘এ টিম’, ‘১৯৭১ ফ্রিডম বাংলাদেশ’ প্রভৃতি।
পুলিশের দাবি, এসব গ্রুপে ফয়সাল নিয়মিত লেখালেখি ও যোগাযোগ রাখতেন। ফলে ঘটনার ভিকটিম হলেও নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পরিকল্পিত অপহরণ?
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, ‘ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে। চারজন গ্রেপ্তার আছে, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে। ভিকটিমের রাজনৈতিক পটভূমিও তদন্তে যাচাই করা হচ্ছে।’
পাঁচলাইশ থানার ওসি মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে এটি পরিকল্পিত অপহরণ বলে মনে হচ্ছে। মামলার প্রতিটি দিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’
দুই দিকেই মামলা, তদন্তে নতুন জটিলতা
আইনজীবী আবু তৈয়ব বলেন, ‘অপহরণ যেই করুক, এটি অপরাধ। তবে ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে যদি আলাদা মামলা থাকে, সেটি পৃথকভাবে বিবেচনা হবে।’
ফয়সালের বিরুদ্ধে পূর্বে দায়ের হওয়া আরেকটি মামলাও তদন্তাধীন। ফলে তিনি একদিকে অপহরণের ভুক্তভোগী, অন্যদিকে আসামি।
চট্টগ্রাম শহরের পার্কভিউ হাসপাতালের ভেতর থেকে প্রকাশ্যে অপহরণের এই ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতালের নিরাপত্তা কোথায় ব্যর্থ হলো, কিংবা থানা থেকে মাত্র ৩০ গজ দূরে এমন সাহসী অপহরণ কীভাবে ঘটল—সেটি নিয়েই এখন তদন্তের নজর।
জেজে/সিপি


