১২ ব্যাংকে ফজলে করিমের লেনদেন ১০৮ কোটি, দুদকের তদন্তে ‘গোপন সম্পদে’র পাহাড়
কারাগারে পিটিয়েছেন সাবেক এমপিকে
১১৪ কোটির অবৈধ সম্পদ, ১২টি ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন, জেল থেকে পালানোর চেষ্টা, এমনকি কারাগারে সহকর্মী এমপিকে মারধরের অভিযোগ— এমন সব অভিযোগ ওঠা সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবশেষে দুর্নীতির মামলা দায়ের করল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঘুষ-দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, অস্ত্র উদ্ধার থেকে শুরু করে ভূমি দখল ও চাঁদাবাজির মতো একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত এই সাবেক সাংসদের বিরুদ্ধে চলমান তদন্তে উঠে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।

চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দায়ের করা মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ১১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
রোববার (১৩ জুলাই) দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. নিজাম উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ফজলে করিমের বিরুদ্ধে দুদক আইন, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপপরিচালক সুবেল আহমেদ জানান, ‘ফজলে করিম চৌধুরী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ৫ কোটি ৯৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এছাড়া ১২টি ব্যাংক হিসাবে ১০৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও মিলেছে।’
অবৈধ সম্পদের হিসাব
দুদক জানায়, তদন্তে ফজলে করিমের নামে ২৪ কোটি ৮ লাখ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ১২ কোটি ১৩ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। অথচ তার আয়কর রিটার্নে বৈধ আয়ের পরিমাণ মাত্র ১৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ফলে ৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয়ের বাইরে অর্জিত বলে মনে করছে সংস্থাটি।
এছাড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ১২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের চেষ্টা করেছেন। ওই হিসাবগুলোতে ৫৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা ও ৫৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
লোকচক্ষুর আড়াল থেকে হেলিকপ্টারে জেল
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংসদ ভেঙে দিলে সংসদ সদস্য পদ হারান ফজলে করিম। এরপর আত্মগোপনে চলে যান তিনি। পরে ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
১৯ সেপ্টেম্বর একটি হেলিকপ্টারে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। আদালতে হাজির করার সময় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রিজন ভ্যানে ডিম ছুড়ে মারে। এরপর থেকে ভার্চ্যুয়ালি শুনানি হচ্ছে তার মামলাগুলোর।
কারাগারেও স্বরূপে
২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সেলে থাকা অবস্থায় ফজলে করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমপি এম এ লতিফের হাতাহাতি হয়। অভিযোগ, গোপনে রাখা মোবাইল ফোন ব্যবহারকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটি থেকে শুরু হয় এই সংঘর্ষ। ফজলে করিমের ঘুষিতে লতিফ মাথায় আঘাত পান এবং তার নাক দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। প্রথমে তাকে কারা হাসপাতালে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
যদিও চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মঞ্জুর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ‘লতিফ টয়লেটে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন।’
পুরনো অভিযোগের পাহাড়
ফজলে করিমের বিরুদ্ধে ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যা চেষ্টা, গহিরার বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধারের মামলাসহ এক ডজনের বেশি ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, এতদিন এসব ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, এখন একে একে সব ‘অজানা সম্পদের কাহিনী’ বেরিয়ে আসছে।
দুদক বলছে, শুধু বিপুল অঙ্কের টাকার লেনদেন নয়, বরং এর ধরণ ও উৎস সন্দেহজনক, যা অর্থপাচার রোধ আইনের আওতায় গুরুতর অপরাধ।
সিপি