বিশ্বাসঘাতকতা! তিন কোটির বার্জ জাহাজ চট্টগ্রামে ভাড়া, নারায়ণগঞ্জে কেটে টুকরো
অভিনব প্রতারণায় স্ক্র্যাপ ‘মালেক শাহ কুতুবদিয়া’
বিশ্বাস আর সরলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ভাড়া করা তিন কোটি টাকা মূল্যের একটি ডাম্ব বার্জ জাহাজকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে শিপইয়ার্ডে তুলে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার ভয়ংকর অভিযোগ উঠেছে একটি প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে। পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত এই অভিনব প্রতারণা যেন ডাকাতিরই আরেক রূপ। ‘মালেক শাহ কুতুবদিয়া’ নামের জাহাজটি এভাবে স্ক্র্যাপে পরিণত হওয়ায় মালিকপক্ষের আনুমানিক ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
গত ২৩ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে আটটার দিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানাধীন কাদিরগঞ্জ মেঘনা নদীর তীরের এইচবি হারুন ব্রাদার্স মেঘনা শিপইয়ার্ডে জাহাজটি কেটে ফেলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জাহাজটির দুই মালিক সাতজনকে আসামি করে সোনারগাঁও থানায় একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন।
ভাড়া থেকে জালিয়াতি ও স্ক্র্যাপে রূপান্তর
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ‘ডিবি সোনারতরী এমজিডি–১’ নামে পরিচিত এবং ডি-১৪১৬৩ রেজিস্ট্রেশন নম্বরের বার্জটির মালিক চট্টগ্রামের রাউজানের রাকেশ শর্মা ও মিঠুন শীল। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৪৫.৭৩ মিটার, প্রস্থ ১৪.৩২ মিটার এবং ডেক দণ্ডের গভীরতা ২.৭৪ মিটার। এই ডাম্ব বার্জের নিজস্ব কোনো চালিকাশক্তি না থাকায় এটি মূলত পণ্য পরিবহন ও খননকাজে ব্যবহৃত হয় এবং টাগবোটের সাহায্যে বা নদীর স্রোতে ভেসে চলে।
এই বার্জটি বিভিন্ন সময়ে ভাড়ায় পরিচালনার সুবাদে অভিযুক্ত মো. জাফর, যিনি চট্টগ্রাম নগরের চাঁন্দগাঁও পূর্ব মোহরা এলাকার বাসিন্দা, মালিকপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়েই মো. জাফরসহ অন্য আসামিরা যোগসাজশ করে এক মাসের জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার টাকায় স্ট্যাম্পে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বার্জটি ভাড়া নেন। চুক্তি অনুযায়ী, গত ১ নভেম্বর জাহাজটি চট্টগ্রামের বাকলিয়ার চরঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রতারক চক্রে অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন চট্টগ্রামের চাঁন্দগাঁও পূর্ব মোহরা এলাকার শাহাদাত, সোনারগাঁওয়ের ইকবাল, নোয়াখালীর নজরুল ইসলাম, ঢাকার মিরপুর শেওড়াপাড়ার এমদাদুল হক, এবং মো. জাফর ও হোসেন। এ ছাড়া আরও ৫ থেকে ৭ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
বার্জ কাটার ঘটনা ও মালিকপক্ষের পদক্ষেপ
গত ২৩ নভেম্বর দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বার্জটির সারেং আশরাফ মালিককে ফোন করে জানান যে বার্জটি শিপইয়ার্ডের ডকে তুলে কেটে ফেলা হচ্ছে। এমন খবর পেয়ে মালিক রাকেশ শর্মা ও মিঠুন শীল দ্রুত সোনারগাঁওয়ে যান এবং রাত সাড়ে আটটার দিকে দেখেন যে জাহাজটির একাধিক অংশ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। মালিকপক্ষ সেখানে গিয়ে অভিযুক্তদের এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা অসংলগ্ন কথা বলেন এবং মালিককে প্রাণনাশের হুমকি দেন।
পরে জানা যায়, প্রতারক চক্রটি একটি ভুয়া বিক্রয় চুক্তিপত্র তৈরি করে। আসামি মো. জাফর ক্রেতা সেজে অপর আসামি এমদাদুল হকের কাছে বার্জটি ‘বিক্রি’ দেখিয়ে জাল দলিল প্রস্তুত করে এই প্রতারণা সম্পন্ন করে।
মালিক রাকেশ শর্মা বলেন, ‘নিজে উপস্থিত হয়ে দেখেছি জাহাজ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আমার ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আইন অনুযায়ী আমি এর বিচার চাই।’
মামলা দায়ের ও ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস
এ ঘটনায় সাতজন নামীয় এবং আরও ৫-৭ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে সোনারগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা (মামলা নম্বর—৩০) দায়ের করা হয়েছে। সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মো. রাশেদুল হাসান খান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বার্জ কেটে ফেলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর তদন্তভার পেয়েছেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাছুম লাভলু। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ডাম্ব বার্জ ও টাগবোট অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হক সুমন বলেন, ‘বিশ্বাসের ওপর ভাড়া নেয়া একটি জাহাজকে এভাবে কেটে ফেলা নিঃসন্দেহে ভয়ংকর অন্যায়। আমরা মালিককে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’
জেজে



