মামলাবাণিজ্যের জাল চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে দুবাইয়ে, নেপথ্যে বিএনপি নেতার নাম
চাঁদাবাজি ও হুমকির শিকার নিরীহ প্রবাসীরা
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক অনেক প্রবাসী ব্যবসায়ী চট্টগ্রামে মামলাবাণিজ্যের জালে পড়ে চাঁদাবাজি, হুমকি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেশে এসব প্রবাসীর পরিবার-পরিজনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ভুয়া এসব মামলার নেপথ্যে ওঠে এসেছে বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতার নাম। মামলাবাণিজ্যের সবকিছুই কেন্দ্রীয় এক নেতার ইশারায় হচ্ছে— এমন অভিযোগ বারেবারেই আসছে। এসব ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর ‘হামলা’র ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ৯ ডিসেম্বর দায়ের করা এই মামলার বাদি জাহিদুল হাসান ওরফে ফাহিম নামের এক ব্যক্তি। দক্ষিণ খুলশী বি-ব্লকের প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে এই লোক ভাড়া থাকেন। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সিটি মেয়র, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ৬০ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় অন্তত ১৩০ ব্যক্তিকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসামি তালিকায় বেশিরভাগ লোকের নাম ঢোকানো হয়েছে মূলত মামলাবাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে। এদের অধিকাংশই নিরীহ ব্যবসায়ী, বিত্তশালী, কেউ কেউ আবার প্রবাসীও। মামলায় ফাঁসানো এমনই একজন— ৩০ নম্বর ‘আসামি’ শাহাদাত হোসেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহাদাত প্রায় ৩২ বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শারজা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় তার একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছেন। গত ১৮ বছর ধরে তিনি একইসঙ্গে জাপানেও ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। গত ৮ বছর ধরে তিনি শারজা ইউজড কার অ্যান্ড স্পেয়ার পার্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সমিতি শারজার অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।

চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা মামলায় যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময় শাহাদাত ছিলেন দুবাইয়ে। এভাবে দূরতম সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তার মতো আরও অনেককেই এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আবার টাকা নিয়ে অনেকের নামও ‘কাটা’ হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে।
মামলাবাণিজ্যে বিএনপি নেতার নাম
প্রবাসী ব্যবসায়ীদের অভিযোগে এমন মামলাবাণিজ্যে ওঠে এসেছে হাটহাজারী বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতার নাম। এদের একজন মোদাচ্ছের শাহ। তিনি বিএনপি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। যুবদলের পদে থাকলেও তিনি ‘বিএনপি নেতা’ হিসেবে পরিচিত। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলালের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তাকে সবাই চেনে। বছরকয়েক আগে শারজায় মোদাচ্ছেরের রোগমুক্তি কামনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মীর হেলাল। আবার কয়েক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আয়োজিত বিএনপির এক সভায় মোদাচ্ছেরকে দেখা গেছে মীর হেলালের পাশে। গত ২০-২২ বছর ধরে আরব আমিরাতে থাকেন— এমন দাবি করে মোদাচ্ছের চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে চাকরি করতাম। বর্তমানে ব্যবসা করি।’

আরব আমিরাতের বাংলাদেশি কমিউনিটি এক নেতা বলেন, ‘প্রবাসে আমরা যারা একটু ভালো অবস্থানে আছি, এদেরকে বেছে বেছে দেশে মামলায় নাম ঢুকিয়ে মামলাবাণিজ্য করছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী কিছু লোক। আমরা দেশের জন্য প্রবাসে রাতদিন কষ্ট করছি, আবার নামধারী কিছু দলীয় লোক দেশ থেকে আমাদের হয়রানি করছে। আমরা অনেক ব্যথিত।’
এদিকে ভুয়া মামলায় নাম ঢোকানোয় মোদাচ্ছের শাহর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রবাসী শাহাদাত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জনৈক বিএনপি নেতার নাম ব্যবহার করে দুবাই ও শারজায় বাংলাদেশ কমিউনিটি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এই মোদাচ্ছের শাহ। এসব কারণে ঘন ঘন আরব আমিরাত ও বাংলাদেশে যাওয়া-আসা করছে। তার ট্রাভেল হিস্ট্রি চেক করলে যার প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
যার দিকে অভিযোগের তীর উঠেছে, সেই মোদাচ্ছের শাহ সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শাহাদাত হোসেন যেসব অভিযোগ তুলেছেন, তার কোনো সত্যতা নেই। আমি তাকে কখনও ফোনও করিনি। অন্য কারও মাধ্যমেও তাকে হুমকি দিইনি। আমি আরেকজনের মোবাইল থেকে তার পরিচিত একজনের মাধ্যমে হুমকি দিয়েছি— এমন কথা হাস্যকর। শাহাদাত সাহেবের সঙ্গে শুধু একবার বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দেখা হয়েছিল। তবে কনস্যুলেটে উনি মারধরের চেষ্টা যে অভিযোগটি করেছেন, সেটাও মিথ্যা। আমিও চাই, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সত্যতা যাচাই করা হোক। তিনি আগে স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন, এখন আমাদের পার্টিকে ছোট করার জন্য এসব বলছেন।’
চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল করিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবগুলো মামলারই আমরা তদন্ত করছি। আমাদের মনিটরিং সেলও বিষয়গুলো দেখছে। তদন্তে কেউ নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।’
প্রবাসেও মামলাবাণিজ্যের জাল
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকায় প্রবাসী ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন কখনও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হননি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকে তিনি একদল দৃর্বৃত্তের হাতে বারবার হয়রানির মুখে পড়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। দুর্বৃত্তরা রাজনৈতিক পরিচয়ে কখনও তাকে মামলায় জড়ানোর ভয়, কখনও চাঁদা দাবি— সবই করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট বিজয় উদযাপনের লক্ষ্য নিয়ে আরব আমিরাত থেকে চট্টগ্রামের নিজ বাড়িতে যান। ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি হাটহাজারীতে ছাত্রআন্দোলনে জড়িত বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন। পরে তিনি আরব আমিরাতে ফিরে যান। এর কিছুদিন পর প্রবাসী ব্যবসায়ী শাহাদাত হঠাৎ খবর পান, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তার গ্রামে গিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মোদাচ্ছের শাহ নামে এক ব্যক্তি তার খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে রোববার (২৯ ডিসেম্বর) আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশ শারজাহ সমিতির অফিসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী ব্যবসায়ী শাহাদাত অভিযোগ করেন, ‘এই গায়েবি মামলার কারণে আমি চরমভাবে অপমানিত বোধ করছি। এভাবে হয়রানির কারণে প্রবাসে আমি ব্যবসায়িক কাজে মন বসাতে পারছি না। আমার পরিবারও আমার এই অবস্থার কারণে মানসিকভাবে অস্থিরতায় ভুগছে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শারজাহ বাংলাদেশ সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী করিমুল হক, অর্থ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, দপ্তর সম্পাদক বদিউল আলম, সমিতির সিনিয়র সদস্য প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম, মাজহারুল আলম মাহবুব সিআইপি, সালেহ আহম্মদ সিআইপি, আল মামুন, মোহাম্মদ বাশার, ইউজড কার স্পেয়ার পার্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ মাহবুব আলম, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আমিন, শারজাহ সমিতির আজীবন সদস্য মোতাহার হোসেন, কমিউনিটি নেতা জাহাঙ্গীর আলম রুপু, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি কামাল হোসাইন সুমন, সহ সভাপতি তরিকুল ইসলাম শামীম, অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।
কনস্যুলেটে মারধরের চেষ্টা
সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী ব্যবসায়ী শাহাদাত যুবদল নেতা মোদাচ্ছেরের তৎপরতা সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, ‘গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আমিসহ বাংলাদেশ সমিতি শারজার দুজন কর্মকর্তা সাংগঠনিক কাজে সদ্য বিদায়ী কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেনের সাথে দেখা করতে যাই। এ সময় সেখানে মোদাচ্ছের শাহ নামক ওই ব্যক্তির সাথে দেখা হয়। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আমার গ্রামে আমার ব্যাপারে কেন খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে? এতে মোদাচ্ছের শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে চরমভাবে গালাগাল ও আমার উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে। কক্ষে উপস্থিত কনসাল জেনারেলের সচিব আব্দুস সবুর ও আমার দুজন সহকর্মী তার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন। মোদাচ্ছের শাহ আমাকে প্রহার করতে না পেরে সে দেশে গেলে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এর কিছুক্ষণ পর মোদাচ্ছের শাহ ক্ষিপ্ত অবস্থায় আমাকে গালাগাল করতে করতে কনস্যুলেট প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে যায়। পুরো বিষয়টি ওই তারিখে কনস্যুলেটের সিসি ক্যামেরা চেক করলে পাওয়া যাবে।’
ঘটনার সময় ছিলেন দুবাই
প্রবাসী শাহাদাত বলেন, ‘এর মধ্যে আমি জাপানে থাকাকালে দেশে থাকা পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে জানতে পারি, পুলিশ আমাকে বাড়িতে খুঁজতে গিয়ে জানিয়েছে, কোতোয়ালী থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আমাকে তারা খুঁজতে এসেছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মামলার বাদি মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান নামের এক লোক। ৯ নভেম্বর দায়ের করা মামলাটির নম্বর ১২। ওই মামলায় ঘটনার তারিখ লেখা হয় ৪ আগস্ট। অথচ তখন আমি আরব আমিরাতের বাড়িতে। আমার মনে হয় না মামলার বাদি আমাকে চেনেন এবং বাদিকেও আমি চিনি। তাছাড়া আমি যেহেতু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই, আমার কোন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকারও কথা না।’
বাড়াবাড়ি করলে আরও ৩০০ মামলা দেবো
তিনি বলেন, ‘খবর নিয়ে জানতে পারি যে, মোদাচ্ছের শাহ দুবাই দূতাবাসের ঘটনার পর পর বাংলাদেশে যায়। আবার কিছুদিন পর গত ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে ফিরেও আসে। তখন শারজা বাংলাদেশ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মাহমুদের মোবাইল থেকে আমার পরিচিত অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামের মোবাইলে কল দেন। এই সময় মোদাচ্ছের শাহ নামে ওই লোক সাইফুল ইসলামকে বলেন, আপনার ভাই শাহাদাতের বিরুদ্ধে একটি মামলা দিয়েছি। বাড়াবাড়ি করলে প্রয়োজনে আরও ৩০০টি মামলা দেবো। এতেই প্রমাণ হয়ে যায় মোদাচ্ছের শাহ আমাকে গায়েবি মামলায় ফাঁসিয়ে ক্ষতি করতে চান। বাংলাদেশে খবর নিয়ে এটাও জানতে পারি মোদাচ্ছের শাহ হচ্ছে মামলার বাদি জাহিদুল হাসানের বন্ধু এবং দুজনেই বিএনপির অনুসারী। ফলে আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি মোদাচ্ছের শাহ এই মামলায় আমাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস— প্রথমত শত্রুতামূলক, দ্বিতীয়ত ভুয়া মামলা দিয়ে টাকা পয়সা আদায় করার জন্য জাহিদুল হাসান নামে ওই ব্যক্তিকে প্ররোচনা দিয়ে আমাকে এই মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই প্রবাসী ব্যবসায়ী বলেন, ‘একজন অসহায় প্রবাসী হিসেবে আমি এই গায়েবী মামলার প্রসঙ্গে আপনাকে অবগত করছি। আমার অভিযোগে যেহেতু বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একজন কর্মীর নাম এসেছে সুতরাং আপনি এই বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এটাই প্রত্যাশা করি।’
সিপি