চট্টগ্রামের আদালতের কাঠগড়ায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন এক আসামি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানাচ্ছেন বলেই রেকর্ডে উল্লেখ। নথিতে রয়েছে এমন তথ্যই। অথচ সরকারি কাগজপত্র বলছে ভিন্ন কথা। সেই আসামি আসলে বহু দূরে, সৌদি আরবে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন!
অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রামের পাথরঘাটার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সানি বিদেশে থাকলেও তার ছোট ভাই আদালতে গিয়ে ‘সানি’ সেজে হাজিরা দিয়ে আসছেন। আদালতের নথি, পাসপোর্ট ও টিকিটের তথ্যের অমিল মিলিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ইঙ্গিত।
বিদেশ গেছেন দুই বছর আগে
সরকারি নথিপত্র থেকে জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম সানি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন পাসপোর্ট (নং A07100629) সংগ্রহ করেন। এরপর ওই বছরের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে ওমান হয়ে সৌদি আরবের রিয়াদে যান। ইমিগ্রেশন রেকর্ড ও এয়ার টিকিট তার বিদেশ যাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরে তিনি রিয়াদের একটি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে পণ্য লোড-আনলোডের কাজ শুরু করেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা ‘আকামা’র কাগজও প্রমাণ করছে তার কর্মস্থল।
মামলার বৃত্তান্ত
২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি কোতোয়ালী থানায় জি আর ১২/২০২৩ মামলায় সানি ও নকিব মোস্তফার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এজাহারে বলা হয়, তারা চোরাই মালামাল কেনাবেচা ও হেফাজতে রাখার সঙ্গে জড়িত। তদন্ত শেষে একই বছরের ২ মে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয়। প্রথমে দণ্ডবিধির ৪১৩/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হলেও আদালত তা পরিবর্তন করে ধারা ৪১১ অনুযায়ী চার্জ গঠন করেন। এই ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হতে পারে।
রেকর্ডে এক কথা, পাসপোর্টে অন্য
আদালতের নথিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল সানি সময় প্রার্থনা করেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের দিন তাকে ‘হাজির’ দেখানো হয়েছে। পরবর্তী তারিখগুলোতেও নিয়মিত তার হাজিরার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পাসপোর্ট ও ভিসা নথি প্রমাণ করছে, ওই সময় সানি রিয়াদেই ছিলেন।
বড় ভাই সেজে ছোট ভাইয়ের হাজিরা
বাদীপক্ষের অভিযোগ, সানির ছোট ভাই তাহসান ইসলাম সোহাম আদালতে গিয়ে নিজেকে ‘সানি’ পরিচয় দিয়েছেন। ওই সময় ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তিনি রাজনৈতিক পরিচয়কে কাজে লাগিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও তার হাতে কোনো পদ-পদবি নেই।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘সানি ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে বিদেশে আছেন। অথচ আদালতের নথিতে তাকে হাজির দেখানো হচ্ছে। আদালত ২০২৬ সালের ৭ জানুয়ারি তাকে পাসপোর্টসহ হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’
আদালতের ভেতরের প্রশ্ন
আইনজীবীরা বলছেন, শুধুমাত্র আসামির ভাই হাজির হলেই আদালত বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়। হাজিরার সময় সাধারণত এনআইডি যাচাই করা হয়, আদালতের কর্মচারী ও বেঞ্চ সহকারীরাও এতে সম্পৃক্ত থাকেন। তাহলে পুরো প্রক্রিয়ায় কে বা কারা সহযোগিতা করেছেন, সেটি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।
যা বলছেন আইন কর্মকর্তারা
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের মফিজুল হক ভূইয়া বলেন, ‘হাজিরা দিতে ব্যর্থ হলে ওয়ারেন্ট জারি হতে পারে। এতদিনের হাজিরার ব্যাপারেও শোকজ হতে পারে।’
সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক জেলা পিপি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কোনো আসামি যদি বিদেশে যেতে চান, আদালতের অনুমতি নিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া চালানো যায়। কিন্তু অনুমতি ছাড়া মিথ্যা হাজিরা দেখানো হলে যারা এতে জড়িত, সবাই অপরাধ করেছেন। মিথ্যা হাজিরা দেওয়া ও গ্রহণ দুটোই অন্যায়।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী চৌধুরী মনে করেন, ‘মিথ্যা হাজিরা আদালত অবমাননা নয়, সরাসরি অপরাধ। প্রমাণিত হলে জামিন বাতিল হবে এবং আইনজীবী জড়িত থাকলেও তিনি দায় এড়াতে পারবেন না।’
সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. তাজ উদ্দীন বলেন, ‘ভুয়া হাজিরার শাস্তি আছে, আদালত বার কাউন্সিলেও নোটিশ দিতে পারেন।’
চট্টগ্রাম প্রসিকিউশন শাখার পুলিশ পরিদর্শক আমিনুর রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য হলে এটি প্রতারণা এবং সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ।’
চোখ এখন ৭ জানুয়ারির দিকে
৩১ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি, নতুন তারিখ পড়েছে ২০২৬ সালের ৭ জানুয়ারি। আদালতপাড়ায় প্রশ্ন উঠছে, এই দীর্ঘ বিরতি কি আসামিকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়ার জন্য? এর মধ্যেই আসামি নকিব মোস্তফা ও সানির আইনজীবী উৎপল দাশকে ফোনে পাওয়া না যাওয়ায় আরও রহস্য যোগ হয়েছে।
সিপি