ফ্যাক্ট চেক/ ভাইরাল ভিডিওতে নির্যাতিত স্কুলছাত্রকে ‘চবি শিক্ষার্থী’ বানিয়ে ছড়ানো হয় আতঙ্ক
বাইরে থেকেও রামদার বস্তা ঢুকেছিল ক্যাম্পাসে
বিলের মধ্যে ফেলে এক কিশোরকে পেটাচ্ছে কয়েকজন। কিশোর প্রাণপণে ছুটছে বাঁচার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। ঘিরে থাকা লোকজন একের পর এক আঘাত হানছে তার শরীরে। রোববার বিকেল থেকে এই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা ছিল—‘খুঁজে খুঁজে চবি শিক্ষার্থীদের কুপিয়েছে জোবরাবাসী।’

কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এক ভিন্ন তথ্য। ভিডিওতে যে ছেলেটিকে মারধর করা হচ্ছে, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। তার নাম সোলাইমান, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জোবরা পিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র। মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে প্রথমে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেলে, পরে ছাত্রদের ভয়ে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় এক বেসরকারি হাসপাতালে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিডিওতে সোলাইমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেখানো এবং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ঘটনার সত্যতা না বোঝার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রামে সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ে।

‘ভয় আছে, কথা বলতে চাই না’
হাসপাতালে সোলাইমানের সঙ্গে থাকা এক স্বজন বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আসছিল। তাই ভয়ে আমরা অন্য হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানেও কয়েকজন ছাত্র আছে। তারাও বুঝে ফেলেছে সোলাইমান জোবরার লোক। আমরা কিছু বলতে চাই না। এখানে ঝুঁকি আছে।’

সোলাইমান যে স্কুলের ছাত্র, সেই পিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. শফিউল আলম বলেন, ‘সে মানবিক বিভাগের ছাত্র। রোববার পরীক্ষায় আসেনি, পরে শুনলাম সে হাসপাতালে।’
অজ্ঞান কিশোরকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের গাড়িতে
হাটহাজারী ফতেহপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর জোবরা ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুল কাদের বলেন, ‘সোলাইমানকে পেটানোর পরে সে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ ওই অবস্থায় তাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে কোথায় আছে তাও জানা যায়নি। এর মধ্যে কথা ছড়ায় সে মারা গেছে। তখন উত্তেজনা আরও বাড়ে৷ সন্ধ্যার দিকে তার মাকে ফোন করে থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ বলে ওকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে নিতে হবে। তবে সে এই ঘটনায় আহত হয়েছে তা কোথাও বলা যাবে না।’
জোবরাজুড়ে আতঙ্ক
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের বলেন, ‘সোলাইমানকে বিলের মধ্যে ফেলে পেটানো হয়েছে। সে সহ অন্তত ১০ জন গ্রামবাসী গুরুতর আহত হয়েছে। নারীরাও মার খেয়েছেন, কিন্তু তারা এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।’
গ্রামবাসী খুবই আতঙ্কিত—এমন কথা জানিয়ে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘গ্রামে এই মুহূর্তে কোনো পুরুষ নেই। নারীরাও ভয়ে আছে। ঘরে ঘরে ঢুকে হামলা হয়েছে, ফ্রিজ থেকে জিনিসপত্র লুট হয়েছে, কয়েক ঘর থেকে এনআইডি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবই ঘটেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে। আমরা কোথাও থেকে কোনো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাচ্ছি না।’
যেভাবে শুরু হয় সংঘর্ষ
শনিবার রাতে জোবরার মাছবাজারের পাশে এক ছাত্রীর সঙ্গে দারোয়ানের ঝগড়া বাঁধে। এর জেরে রোববার দিনভর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল তিনটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী দেখা যায়নি। পরে তারা এলে জোবরা গ্রামে ব্যাপক হামলা শুরু হয়। গ্রামবাসীর মোটরসাইকেল, সিএনজি, দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ঘরবাড়ি লুট হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র বলছে, রাতে ঘটনার পর সকালে কিছু শিক্ষার্থী গ্রামে আটকা পড়ে। উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ছাত্র তাদের উদ্ধারে গেলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অতর্কিত হামলা চালায় সেখানে। এতে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, সংঘাতে ৪০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ছাত্রদের দাবি আরও বেশি—প্রায় দেড় হাজার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের হিসাব অনুযায়ী সেখানে চিকিৎসা নিয়েছে মোট ৭৪ জন।
কিছু শিক্ষার্থীর অভিযোগ, আসন্ন চাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রসংগঠনের নেতারা পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা প্রথম আলোর আলোকচিত্র সাংবাদিক জুয়েল শীল জানান, ‘পুরো ঘটনাটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার ফল। শুরুতে গ্রামবাসীরা সংঘাতে যেতে চাননি। শিক্ষার্থীরাই প্রথমে গ্রামে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপরই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন যদি দায়িত্বশীলভাবে পরিস্থিতি সামাল দিত, সকাল ১০টার মধ্যেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসত। এত শিক্ষার্থী আহত হতো না। এমনকি আমরা কয়েকজন ফটোসাংবাদিক মিলে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রামবাসীর হাত থেকে বাঁচিয়েছি।’
রামদা লুটে সহকারী প্রক্টরের স্বীকারোক্তি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নাজমুল হোসাইন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব পক্ষের সাথে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৈঠকে স্বীকার করেন, ‘৫ আগস্টের পরে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৬০ পিস রাম দা কালেক্ট করি। এই অস্ত্রাগারকে লুট করার জন্য ছয়টি তালা ভাঙা হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। উনারা ছাত্রদের পায়ে পড়েছেন। প্রোভিসি এডমিন স্যার শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেছেন, তোমরা প্লিজ এটা করবা না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটা ভালো দেখাবে না। অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা আমরা কিছু করতে পারিনি। প্রায় ১৩০ পিস রামদা আমাদের অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে। সেটার জন্য আমাদের সকল ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতা চাই। এবং সেটা কখনো হয়ত আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি।’
নাজমুল হোসাইন আরও বলেন, ‘আরেকটা ভয়ংকর বিষয় এখানে বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আমরা জানি না হয়েছে কিনা, ২০ রাউন্ডের মতো শর্টগানের গুলি আমরা ফুটিয়েছি। কেন? কারণ হচ্ছে, ছাত্রদেরকে ব্যাকআপ দিয়ে পিছনের দিকে নিয়ে আসার জন্য। বারবার ছাত্রদের বলেছি, ফায়ার হবে ওপরের দিকে, তোমরা ব্যাকে যাবা। এই কথাটা আমাদের কোনো ছাত্র শোনে নাই। ওরা বরঞ্চ আরো বেশি পরিমাণে সংঘর্ষে পূর্ব দিকে চলে যায়। আমাদের ছাত্ররা হয়তোবা মোমেন্টামের কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্রগুলো বারবার নিয়ে নিচ্ছিল। এটা ভয়ংকর একটা বিষয়। যে-কোনো সময় একটা মিস ফায়ার হয়ে যেতে পারতো।’
বাইরে থেকেও ক্যাম্পাসে ঢোকে রামদার বস্তা
সংঘর্ষ চলাকালে রোববার দিবাগত রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক স্টুডেন্ডস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির মুখপাত্র জগলুল আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গ্র্যান্ড সাবোটাজ করা হইতেছে। ছেলেদের হাতে রামদা তুলে দিচ্ছে একটা গ্রুপ। এরা ক্যাম্পাসে লাশ চায়।’
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব রাহাদুল ইসলাম সরাসরি অভিযোগ তোলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় সময়ের সুযোগে অনেক বহিরাগতকে দিয়ে ক্যাম্পাসে রামদা আনা হয়েছে।’
সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারভিত্তিক কিশোরগ্যাং ডট গ্যাংয়ের তৎপরতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রোববার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে আমি এবং আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা ষোলশহর স্টেশনে পৌঁছি। আমরা সবাই যে যার মতো লাঠিসোটা নিয়ে গিয়েছিলাম আত্মরক্ষার্থে। ঠিক তখনই দেখি একটি সিএনজি নিয়ে সাদিক আরমান (কিশোরগ্যাং ডট গ্যাংয়ের সদস্য) হাজির হলো। তার সঙ্গে ছিলো একটি সিঙ্গেল বেড, যা বস্তার মধ্যে মুড়িয়ে রাখা। মুহূর্তেই উপস্থিত সবাই বুঝে যায় ওই বেডের ভেতরে আসলে কী লুকানো ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে শাটল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সাদিক ও তার সহযোগী বন্ধু ইয়ামিন কাফি বস্তাটি নামালো। কাফি ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির একটি লাইভ ভিডিওতে ছুরিসহ হাতেনাতে ধরা পড়ার পর শোকজ নোটিশ পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে। বস্তা নামানোর পরপরই নৃবিজ্ঞান বিভাগের জুবাইর লিংকনসহ আরও একজন একটি মোটরবাইকে এসে সেটা নিয়ে গেলেন। আমার কাছে হিডেন ক্যামেরা থাকলেও লিংকন ভাইয়ের পুরো চেহারাসহ ছবি বা ভিডিও তুলতে পারিনি। তবে অনেকটাই রেকর্ড করতে পেরেছি।’
সিপি