২৪ কোটির কেলেঙ্কারিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট, অভিযুক্ত দুই ব্যাংকারও
কাজ অসম্পূর্ণ, তবু ২৫ কোটি টাকার চেক!
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে কোটি টাকার দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় তার সঙ্গে আরও তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দুদক জানায়, পোর্ট কানেকটিং (পিসি) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং সাড়ে ৪ কোটি টাকার সরকারি ক্ষতির ঘটনায় এ চার্জশিট দাখিল করা হয়। আগামী ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে চার্জশিট গ্রহণের বিষয়ে শুনানি হবে।
নিয়ম ভেঙে ঠিকাদারকে ২৫ কোটি টাকার চেক
দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে দায়িত্বে থেকে সাইফুদ্দিন নিজের পদমর্যাদার অপব্যবহার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স রানা বিল্ডার্স’ এবং ‘মেসার্স রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমদ (জেভি)’–কে অবৈধ সুবিধা দেন।
প্রকল্পের বিপরীতে ওই প্রতিষ্ঠানটি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) কুমিল্লা শাখা থেকে ঋণ নেয়। চুক্তি অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনের বিলের অর্থ সরাসরি ব্যাংকের নির্দিষ্ট হিসাবে জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাইফুদ্দিন নিয়ম ভঙ্গ করে ব্যাংকের পরিবর্তে সরাসরি ঠিকাদারের নামে প্রায় ২৫ কোটি টাকার চেক ইস্যু করেন।
এ টাকা পেয়ে ঠিকাদার কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই উধাও হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কটি ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকে, ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।
দুর্নীতি শুধু এক প্রকল্পে সীমাবদ্ধ নয়
দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইফুদ্দিনের অনিয়ম কেবল এই প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ঠিকাদারদের বিল থেকে কেটে নেওয়া ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেননি।
এ ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের কোটি টাকাও নির্দিষ্ট হিসাবে জমা না দিয়ে আত্মসাত করেছেন বলে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দীর্ঘ তদন্ত, একাধিকবার শোকজ ও বরখাস্ত
সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বহু আগেই। ২০২০ সালে প্রথম দফায় সিটি কর্পোরেশন তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক তাকে শোকজ করেন।
এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আবারও তদন্ত হয় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (মামলা নং ০১/২০২১) করা হয়। একাধিক তদন্তে দেখা যায়, ২০১৮–২০২০ অর্থবছরে ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের বিলের বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ মোট ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা কর্তন করেও সরকারি কোষাগারে জমা দেননি তিনি।
অবশেষে ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিটি কর্পোরেশন। পরের বছর ২০২৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাইফুদ্দিনকে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ আরও তিনজন অভিযুক্ত
চার্জশিটে সাইফুদ্দিন ছাড়াও আরও তিনজনের নাম রয়েছে, তারা হলেন— কুমিল্লার ঝাউতলার বাসিন্দা ও মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জাকির হোসেন, ইউসিবিএল ব্যাংকের সাবেক এফভিপি ও শাখা প্রধান (বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত) মো. সরোয়ার আলম, এনআরবি ব্যাংকের এভিপি ও কুমিল্লা শাখার প্রধান মো. তোফায়েল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক জালিয়াতি, অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদানে সহযোগিতা ও আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদকের মামলা ও আদালতের নির্দেশ
২০২২ সালের ১০ মে দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। প্রথম চার্জশিট আদালত গ্রহণ না করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিলে, তদন্ত কর্মকর্তা মো. বেনজীর আহমদ নতুন প্রমাণ যুক্ত করে পুনরায় চার্জশিট দাখিল করেন।
সাইফুদ্দিন উচ্চ আদালতে জামিনের চেষ্টা করলেও তাকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন পান।



