প্রিয় নবীজির (সা.) প্রতি ভালোবাসা ইমানের শর্ত। নবী পরিবার বা আহলে বাইতের প্রতি মোহাব্বত, ভালোবাসাও ইমানের শর্ত। নবীজি (সা.) বলেন “তোমাদের কারও ইমান পূর্ণ হবে না যতক্ষণ না আমি (নবী মুহাম্মদ সা.)তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হব।”
আহলে বাইত কারা?
আহলে বাইত হলো নবী পরিবার-হজরত ফাতিমা (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.)এই পরিবারের সদস্য। এঁদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে নবীবংশ। নবী বংশেরই ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শাহাদত বরণ করেছেন আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে।
কোরআনে আহলে বাইত
আহলে বাইত পবিত্র কোরআনের পরিভাষা। আহলে বাইত হলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধর ও আত্মীয়-স্বজন। আহলে বাইত পারিভাষাটি পবিত্র কোরআনে দুবার এসেছে।
- ইরশাদ হয়েছে “তারা বলল (ফেরেশতারা) তুমি কি আল্লাহর কোনো কাজে বিস্ময়বোধ করছ তোমাদের ওপর সর্বদা আল্লাহর রহমত ও তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে হে আহলে বাইত। অবশ্যই তিনি মহা প্রশংসিত ও মহা মর্যাদাবান।” (সুরা : হুদ : আয়াত : ৭৩)। এ আয়াতে আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)এর স্ত্রীকে আহলে বাইত বলেছেন।
- অপর আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন “হে নবী-পরিবার আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের থেকে নাপাকি দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পূত:পবিত্র করতে।” (সুরা : আহজাব : আয়াত : ৩৩)।
আহলে বাইতের মর্যাদা
প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (রা.) বর্ণনা করেন যে পবিত্র কোরআন ও নবী (সা.)এঁর হাদীস হতে এটা প্রমাণিত হয় যে আহলে বাইত আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (রা.)এঁর মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালোবাসা) দ্বীনের ফরায়েজে গণ্য সুতরাং ইমাম শাফেয়ী (রা.)এটার সমর্থনে এরূপ সনদ দিয়েছেন যে “ইয়া আহলে বাইত-এ রাসূল-আল্লাহ তাঁর নাজিল করা পবিত্র কোরআনে আপনাদের মুয়াদ্দাতকে ফরজ করেছেন যারা নামাজে আঁপনাদের উপর দরুদ পড়বে না তাদের নামাজই কবুল হবে না।”
আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা
আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি ভালোবাসা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নবীপ্রেম (এশকে-রাসূল) ও আল্লাহ প্রেম (এশকে-এলাহি) ছাড়া কোনো মানুষ প্রকৃত মোমিন-মুসলমান হতে পারে না।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস। কেননা তিনি তোমাদের তাঁর নেয়ামতগুলো খাওয়াচ্ছেন। আর আল্লাহর ভালোবাসায় তোমরা আমাকেও ভালোবাস এবং আমার ভালোবাসায় আমার আহলে বায়েতকেও ভালোবাস।”
কোরআন ও আহলে বাইতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা শক্তভাবে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পরে কখনও গোমরাহ হবে না। তার একটি অপরটির চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার পরিবার অর্থাৎ আমার আহলে বায়েত। এ দুটি কখনও পৃথক হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সঙ্গে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব তোমরা লক্ষ কর আমার পরে এতদুভয়ের সঙ্গে তোমরা কেমন আচরণ কর। তোমরা কোরআনকে যতটুকু মর্যাদা দাও তাদেরও ততটুকু মর্যাদা দিও এবং তৃষ্ণার্ত উট যেভাবে পানির ঝর্ণার দিকে ছুটে যায় হেদায়েতের তৃষ্ণা মিটানোর জন্য তোমরাও সেভাবে তাদের দিকে যেয়ো।”
আহলে বাইতের অনুসরণ
নাহ্জ আল বালাঘা-মাওলা আলীর উপরোক্ত হাদিস থেকে স্পষ্ট আমাদের আল্লাহর কোরআন ও রাসূল (সা.) এর আহলাল বায়েত অর্থাৎ আওলাদে রাসূলদের দৃঢ়ভাবে ধারণ বা অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর কোরআন ও আওলাদে রাসূল এ দুটোর একটিকে বাদ দিয়ে হাউজে কাওসারে রাসূল (সা.) এর কাছে যাওয়া যাবে না।
তাদের প্রতি ভালোবাসা
রাসূল (সা.) আত্মীয়-অনাত্মীয় সব ধরনের সাহাবিদের কাছে মা ফাতেমা, হজরত আলী, ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইনের (রা.) সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সদ্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই চাননি। মা ফাতেমা, হজরত আলী, ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইনের (রা.) বংশীয় ধারার আওলাদে রাসূলদের সঙ্গে মহাব্বতের আনুগত্যশীলতাই আল্লাহ ও রাসূলের মূল রিজিক পাওয়ার একমাত্র উপায়।
আহলে বাইতের ফজিলত
- যারা আওলাদে রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল অর্থাৎ তারা সব ধরনের রিজিক পাবে।
- বেহেশতিদের জন্য সব ধরনের উত্তম নিয়ামতপূর্ণ রিজিকের সমাহার রয়েছে।
- বেহেশতি মহিলাদের সর্দার মা ফাতেমাসহ আওলাদে-রাসূলদের প্রতি আনুগত্যশীল মহিলারা বেহেশতি নিয়ামতপ্রাপ্ত হবে মা ফাতেমার নেতৃত্বে।
- বেহেশতি নিয়ামতপ্রাপ্ত যুবকদের সর্দার হচ্ছেন ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন (রা.)।
- ইমাম হাসান-ইমাম হোসাইন (রা.) সহ আওলাদে রাসূলদের প্রতি আনুগত্যশীলরাই বেহেশতে নিয়ামতপ্রাপ্ত হবে।
আহলে বাইতের কল্যাণ
আওলাদে রাসূলদের এ শ্রেষ্ঠত্ব কোনো মানুষ-জিন-ফেরেশতা প্রদত্ত নয় স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূলদের কল্যাণ সাধন করা সমগ্র উম্মতের জন্য রাখা হয়েছে। যারা আল্লাহর পথ ধরে আওলাদে রাসূলের কল্যাণে ব্যয় করবে তার কল্যাণ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন আল্লাহ। আল্লাহর এ প্রতিদান ইহকাল-পরকালে স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে।
নবী পরিবারের মর্যাদা
আহলে বাইতের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত একদিন রাসুল (সা.) মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী অবস্থানে গাদিরে খামের কাছে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং লোকদের উপদেশ দিয়ে বলেন “হে লোকরা আমি মানুষ অচিরেই আমার কাছে আমার প্রভুর দূত (মৃত্যুর ফেরেশতা) আগমন করবেন। আমি সাড়া দেব। আমি তোমাদের কাছে দুটি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি হলো কিতাবুল্লাহ যাতে রয়েছে হিদায়াত ও আলোর দিশা। তোমরা কিতাবুল্লাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং তার ওপরে আমল করো।” অত:পর তিনি কিতাবুল্লাহ তথা কোরআনের প্রতি মানুষদের উৎসাহিত করেছেন। অত:পর তিনি বললেন “আমার আহলে বাইত। আমি তোমাদের আমার আহলে বাইত সম্পর্কে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।” এ কথা তিনি তিনবার বলেছেন। (সহিহ মুসলিম : আয়াত : ۲৪۰۷)
নবী পরিবারের কথা স্মরণ
দরুদ পাঠ করা ঈমানদারদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। মুমিনরা যখন দরুদ পাঠ করেন তখন নবীজি (সা.) এর সঙ্গে আহলে বাইত বা নবীজি পরিবারের ওপরও দরুদ পাঠ করে থাকেন। ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মতে নবীজি (সা.) এর ওপর দরুদ পাঠের সময় তাঁর পরিবারের ওপর দরুদ পাঠ করা ওয়াজিব। হানাফি মাজহাবের ইমামদের মতে সুন্নত।
আওলাদে রাসুল (সা.) ও সাইয়্যেদের পরিচয় ও মহত্তব
আওলাদে রাসুল (সা.)এর অর্থ রাসুলুল্লাহ (সা.)এর সন্তান বা বংশধর। তাঁরা বিশেষ সম্মানের অধিকারী। আওলাদে রাসুল মানে আহলে বাইত নয়। নবী করিম (সा.)এর বংশধরেরা সাইয়্যেদ নামে পরিচিত। তাঁরা আওলাদে রাসুল (সা.)এর অন্তর্ভুক্ত। ইমান আমল ও তাকওয়াই মর্যাদার মাপকাঠি। আল্লাহতাআলা বলেন “হে মানবমন্ডলী! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে অত:পর তোমাদিগকে বিভিন্ন শাখা ও গোত্রে বিভাজন করেছি যাতে তোমরা পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের সে–ই বেশি সম্মানিত যে বেশি তাকওয়াবান।”
পরিশেষে
মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে আওলাদে রাসূল ও আহলে বাইতকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। পবিত্র মহররম মাসে আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার ও দান-খয়রাত করে এবং পরিবার পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার চেষ্টা করি। সবাই যেন আহলে বাইতের অনুসরণ ও মোহাব্বত নিয়ে কবরে যেতে পারি। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট