৪৫০ কোটি খরচ, শূন্য আয়—কর্ণফুলী টানেলের ‘ভিআইপি বিলাস’ এবার ইজারায় যাচ্ছে
টানেলে প্রতিদিন খরচ ৪০ লাখ, আয় মোটে ১০-১২
মাত্র দেড় বছর আগে উদ্বোধন হওয়া সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার কর্ণফুলী টানেলের সংযুক্ত সার্ভিস এরিয়া এতোদিন পর সরকারের কাছে যেন ‘অবাঞ্ছিত বিলাসিতা’। ৪৫০ কোটি টাকা খরচে নির্মিত ভিআইপি বাংলো, সুইমিংপুল, জাদুঘর আর থিয়েটার—সব মিলিয়ে ৭২ একরের এই এলাকা এখন যাচ্ছে ইজারায়। টোল দিয়ে টানেলে চলাচল করে যেখানে সরকারের আয় দৈনিক ১২ লাখ টাকাও ছোঁয় না, সেখানে শুধু রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে এর তিন গুণ। লোকসানের দায় এড়াতে এখন সরকারের ভরসা প্রাইভেট বিনিয়োগ। অন্যদিকে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, আদৌ কি এসব স্থাপনার দরকার ছিল?
টানেলের বিলাস ‘বেচাকেনা’ শুরু এবার
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলটি উদ্বোধনের ১৮ মাস পার না হতেই টানেলের সংযুক্ত সার্ভিস এরিয়া বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেতু বিভাগ। ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সার্ভিস এরিয়ায় রয়েছে ৩০টি ভিআইপি বাংলো, আধুনিক কনভেনশন সেন্টার, সুইমিংপুল, জাদুঘর, থিয়েটার, খেলাধুলার মাঠ ও আবাসন সুবিধা। ৩০ বছরের জন্য এগুলোকে ইজারায় দিতে ১ জুলাই আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা ২৭ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন করতে পারবেন।
সরকার বলছে, লোকসান ঠেকাতে এবং পরিত্যক্ত এই আধুনিক অবকাঠামোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার উপযোগী করতে এই সিদ্ধান্ত। তবে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, প্রকল্প চলাকালে স্থায়ী এই ব্যয়বহুল ‘সার্ভিস এরিয়া’ নির্মাণ আদৌ দরকার ছিল কি না। এই সার্ভিস এরিয়ার অজুহাতে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে নেওয়া হয়, যার বেশিরভাগই মূলত লুটপাট হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে।
৪৫০ কোটির সার্ভিস এরিয়া পড়ে আছে পরিত্যক্ত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘টানেল প্রকল্পের মেয়াদি প্রকৃতির কথা বিবেচনায় নিলে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ অবিবেচনাপ্রসূত। রক্ষণাবেক্ষণের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবং প্রকল্প খরচ অকারণে ফুলিয়ে তোলা হয়েছে। অস্থায়ী অবকাঠামো করে কাজ শেষে জমি ফেরত দেওয়া যেতো।’
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সার্ভিস এরিয়ার জন্য প্রায় ৭২ একর জমি অধিগ্রহণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা স্থাপনাগুলোর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। কিন্তু আজও সেগুলোর কোনো বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়নি। হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই।
তিন গুণ ব্যয়ে চলছে টানেল, আয় কেবল নামমাত্র
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন টানেল রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয় ৪০ লাখ টাকার বেশি। অথচ টোল বাবদ গড়ে আয় হচ্ছে মাত্র ১০-১২ লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে টানেলের সঙ্গে যুক্ত সুবিধাগুলোকে পর্যটন ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের আওতায় এনে বিকল্প আয়ের উৎস গড়ে তুলতে চাইছে সেতু বিভাগ।
সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানান, ‘উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছভাবে ইজারা দেওয়া হবে। হোটেল, মোটেল, কনফারেন্স বা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এই এলাকাগুলো ব্যবহৃত হলে সরকার রাজস্ব পাবে, একই সঙ্গে জনগণও মানসম্পন্ন সেবা ভোগ করতে পারবে।’
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, নির্বাচিত ইজারাদারকে সার্ভিস এরিয়ার সকল স্থাপনা ‘যেমন আছে’ ভিত্তিতে হস্তান্তর করা হবে। ইজারাদার বার্ষিক ভাড়া চার কিস্তিতে পরিশোধ করবে এবং সম্পত্তি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণসহ রুম সার্ভিস, খাবার, ভ্রমণ, সম্মেলন, স্পা ইত্যাদি সেবার মূল্য নির্ধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। তবে কোনো নতুন নির্মাণ বা কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চাইলে ইজারাদারকে সেতু বিভাগের অনুমতি নিতে হবে।
টানেলের পাশে ধুঁকছে ভিআইপি এরিয়া
সার্ভিস এরিয়াটি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সেবা চালু না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি সফর এই এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এটি অলাভজনক স্থাপনা বলেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এবং অবকাঠামো বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, কর্ণফুলী টানেলের বাস্তব রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কতটুকু? ভিআইপি কটেজ ও জাদুঘরের মতো স্থাপনার প্রয়োজনীয়তা কিভাবে নির্ধারিত হয়েছিল? ইজারার পর ভবিষ্যতে এই সম্পদের মালিকানাগত জটিলতা তৈরি হতে পারে কিনা— সেই প্রশ্নও তুলছেন তারা।
জেজে/সিপি