মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান। যে কোনো কিছু করার একচ্ছত্র ক্ষমতাও তার। কুরআনুল কারিমের অনেক আয়াতে এসব ক্ষমতা বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মানুষ যে সব স্থানে নিজেকে অসহায় বা ব্যর্থ ভাবেন সে সব স্থানেও মহান আল্লাহ মানুষকে দেখিয়েছেন সমাধানের পথ। শুনিয়েছেন নেয়ামত ও কল্যাণের কথা। মানুষকে ব্যর্থতামুক্ত করতে তিনি নিজেই নিয়েছেন সে ভার। এসব ব্যর্থতা ও অপারগতা থেকে বেরিয়ে আসতে শুধু প্রয়োজন তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। মুমিনরা কখনো হতাশ হয় না সুখে-দু:খে আল্লাহর প্রতি ভরসা করে। তারা সব সময় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।
কোরআনের উপদেশ
মহান কোরআনুল কারিমে মুমিনদের হতাশ না হওয়ার উপদেশ দেন দুশ্চিন্তা না করার উপদেশ। এ উপদেশেই মুমিনরা কঠিন বিপদেও যেমন মনোবল হারায় না তেমনি হতাশও হয় না। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ মুমিনদের প্রতি উপদেশগুলো এভাবে তুলে ধরেছেন- “আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দু:খিত হয়ো না আর তোমরাই বিজয়ী যদি মুমিন হয়ে থাকো।” (সুরা আল ইমরান : আয়াত : ১৩৯)
হতাশার কারণ ও সমাধান
জীবনের কঠিন সমীকরণ পাপের বোঝা গুনাহ থেকে তওবার অনুভূতি-বিভিন্ন কারণে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশা অনেক সময় অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি করে। কোরআন ও হাদিসে যে কোনো মুহুর্তে ও যে কোনো পরিস্থিতিতে হতাশ না হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং সব হাতাশা ও ব্যর্থতায় আর কারো কাছে নয় শুধু মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং সমাধান চাওয়াই মুমিনের জন্য উত্তম।
“ভেঙ্গে পড়ো না নিরাশ হয়ো না সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা!”
“জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে”! (সূরা-বাকারা : ২১৪)
ফিলিস্তিন ইস্যু ও আল্লাহর পরিকল্পনা
ইসরায়েল পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক ও বর্বর রাষ্ট্র। তারা ফিলিস্তিনে নিরীহ মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। মানবতা চরমভাবে বিপর্যস্ত। অনেকেই বলছেন মহান আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মহান আল্লাহ কি তাদের বর্বর ইসরায়েল থেকে মুক্ত করবেন না?
আল্লাহর পরীক্ষা ও মুসলমানদের দায়িত্ব
কথা হলো মহান আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সব বিষয়ে সক্ষম এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তিনি ইচ্ছা করলেই ইসরায়েল রাষ্ট্র ধসে যেতে পারে। তিনি ফিলিস্তিনের চলমান ঘটনার মাধ্যমে পৃথিবীর মুসলমানদের ইমান পরীক্ষা করছেন। এক্ষেত্রে মুসলমানদের যে দায়িত্ব তা তারা পালন করে কি না এটা দেখাই মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য।
আল্লাহর সাহায্য লাভের শর্ত
আল্লাহর সাহায্য লাভের নির্ধারিত পথ আছে। সাহায্য পেতে হলে সে রাস্তাই অনুসরণ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সাহায্য পেতে চাইলে তাকে ঈমান, ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্যের ওপর নির্ভর হতে হবে। ফলে সে পৃথিবীর সব কিছু ত্যাগ করবে এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করে নেবে। কেননা আল্লাহর সাহায্য তার ভাগ্যেই জোটে তা লাভ করার জন্য যে জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিতে পস্তুত থাকে।
“ধৈর্যের সঙ্গে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করো। অবশ্য তা কঠিন; শুধু বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।” (সুরা ২ বাকারা : আয়াত : ৪৫)
মৃত্যুর প্রকৃত অর্থ
কেউ কেউ বলছেন বর্বর ইসরায়েল রাষ্ট্র এত মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে মহান আল্লাহর কি একটুও খারাপ লাগে না? এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন ইসলামি স্কলার লেখেন আমাদের কাছে মৃত্যু অর্থ যা মহান আল্লাহর কাছে কিন্তু তা নয়। এটা অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না। আমরা ভাবি আল্লাহ এত নিষ্ঠুর কীভাবে হন! এত এত মানুষকে মেরে ফেলার সুযোগ তিনি কীভাবে দিচ্ছেন! কিন্তু আল্লাহর দিক থেকে মৃত্যু হলো এই সমস্যা সংকুল দুনিয়া থেকে ওই মানুষগুলোকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহর দিক থেকে মৃত্যু কোনো নির্দয় ঘটনা নয়। বরং সুন্দর ও শহীদি মৃত্যুই আল্লাহর দিক থেকে বড় অনুগ্রহ।
নবীজির দোয়া ও শাহাদাত
রাসুল (সা.) কোনো সাহাবির জন্য রহমতের দোয়া করলে তিনি শহীদ হতেন। এটা এত বেশি বার ঘটেছিল যে নবীজি (সা.) কারও জন্য রহমতের দোয়া করলে সাহাবায়ে কেরাম বুঝে যেতেন তিনি শহীদ হবেন।
আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী
আমরা বিশ্বাস করি ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য খুব নিকটবর্তী। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে:
“তোমরা কি মনে করো যে তোমরা বেহেশত প্রবেশ করবে? যদিও পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের অবস্থা এখনো তোমরা প্রাপ্ত হওনি। দু:খ-দারিদ্র্য ও রোগ-মসিবত তাদের স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। তারা এতদূর বিচলিত হয়েছিল যে রাসুল (সা.) ও তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীরা বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” (সুরা বাকারা : ২১৪)
নবী-রাসুলদের প্রার্থনার প্রকৃতি
নবী-রাসুল ও তাদের সাথিদের প্রার্থনা “আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে” তারা মহান আল্লাহর প্রতি কোনো সন্দেহের কারণে এমন কথা বলেননি। বরং এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল এই যে যদিও মহান আল্লাহ সাহায্যের ওয়াদা করেছেন তবে এর সময় ও স্থান নির্ধারণ করেননি। অতএব এ অশান্ত অবস্থায় এ ধরনের প্রার্থনার অর্থ ছিল এই যে সাহায্য তাড়াতাড়ি আসুক। এমন প্রার্থনা আল্লাহর প্রতি ভরসা ও শানে নবুওয়াতের খেলাফ নয়। বরং মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের সবিনয় প্রার্থনাকে পছন্দ করেন। বস্তুত নবী-রাসুল ও সৎকর্ম পরায়ণশীলরাই এরূপ প্রার্থনার অধিক উপযুক্ত।
সুরা ফাতিহার শিক্ষা
আমরা সুরা ফাতিহায় যখন বলি ‘ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসত্বায়িন’ (শুধু আপনারই ইবাদত করি আর শুধু আপনার কাছেই সাহায্য চাই)। আল্লাহতাআলা বলেন ‘হাজা বাইনি ওয়া বাইনা আবদি’ (এই সিদ্ধান্তই ফায়সালা হলো আমার ও আমার বান্দার মাঝে বান্দা আমার ইবাদত ও আনুগত্য করবে আমি তাকে সাহায্য– সহযোগিতা করব)।
সিরাতুল মুস্তাকিমের প্রার্থনা
আমরা যখন বলি ‘ইহদিনাস সিরাতল মুস্তাকিম সিরাত্বল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়া লাদ–দল্লিন!’ (আমাদের সঠিক পথ দেখান তাদের পথ যাদের আপনি নিয়ামত দিয়েছেন তাদের পথ নয় যারা অভিশপ্ত (ইহুদি) আর যারা পথভ্রষ্ট (খ্রিষ্টান)। তখন আল্লাহতাআলা বলেন ‘লিআবদি মা সাআল’ (আমার বান্দা যা চায় তার জন্য তাই)।
কোরআনের ঘোষণা
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন।” (সুরা-৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত : ৭)
আল্লাহ সুবহানাহুতাআলা আরও বলেন “এরা (ইহুদি ও তাদের দোসরেরা) কি এর পূর্বে যা ঘটেছে তার অনুরূপ ঘটনার প্রতীক্ষা করছে? বলো তোমরা প্রতীক্ষা করো আমিও তোমাদের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।”
সাহাবায়ে কেরামের পরীক্ষা
মদিনায় হিজরত করার পর মুসলমানরা যখন ইহুদি মুনাফিক এবং আরবের মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পীড়া ও কষ্ট পেতে লাগল তখন কোনো কোনো সাহাবি নবী করীম (সা.) এর কাছে অভিযোগ করল। তাই তাদের সান্তনা দেওয়ার জন্য আয়াত নাজিল হয়।
রাসুল (সা.) এর বাণী
এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন “তোমাদের পূর্বের লোকদের তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরা হতো এবং লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের গোশত ও চামড়াকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হতো। কিন্তু এই অকথ্য জুলুম-নির্যাতন তাদের দ্বীন থেকে ফেরাতে পারেনি। আল্লাহর শপথ! তিনি এই দ্বীনকে এমনভাবে জয়যুক্ত করবেন যে একজন আরোহী (ইয়ামানের) সানআ থেকে হাজরে মাউত পর্যন্ত একা সফর করবে তার মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ভয় থাকবে না।”
উপসংহার
আল্লাহর কাছে মানুষের এতো এতো হতাশার সুন্দর সুন্দর সমাধান ও নেয়ামত থাকার পরও মানুষ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা বা সমাধান চায় না। তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর বঞ্চিত হয় মহান আল্লাহ ঘোষিত এসব অপার নেয়ামত থেকে। সুতরাং সব হাতাশা ও ব্যর্থতায় আর কারো কাছে নয় শুধু মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং সমাধান চাওয়াই মুমিনের জন্য উত্তম।
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে হতাশা দুবলতা ও হীনমনোবল থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁর উপদেশাবলী গ্রহণ করার ও কোরআন-সুন্নাহর দিক নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট