খুঁটির নামে চাঁদাবাজি: ভুয়া সাংবাদিককে গণধোলাই, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব লুটেও আছে নাম
সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সংযোগে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে চাঁদাবাজির অভিযোগে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছেন এক যুবক। তার নাম এম মিলাদ উদ্দিন মুন্না। নিজেকে ‘চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপে চাঁদাবাজি ও নিরীহ লোকদের হয়রানি করে আসছিলেন বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই নামে তাদের কোনো সদস্য নেই। গত বছরের আগস্টে প্রেসক্লাবে হামলা ও লুটপাটের ঘটনাতেও এই যুবক জড়িত ছিলেন।
শুক্রবার (২৭ জুন) সন্ধ্যায় সন্দ্বীপ উপজেলার এনাম নাহার মোড় এলাকায় বিক্ষুব্ধ স্থানীয়রা তাকে মারধর করেন।
বিদ্যুৎ সংযোগে দুর্নীতি ও খুঁটি বাণিজ্য
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নামে শুরু হয় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি), সন্দ্বীপের পিডিবি কর্মকর্তা ও মিলাদ উদ্দিন মুন্নার নেতৃত্বে একটি চক্র স্থানীয় সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতার পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রাহকদের জিম্মি করে খুঁটি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। তারা খুঁটির মালামাল কালোবাজারে বিক্রি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। মুন্নার বিরুদ্ধে পিডিবির বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক তার বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।
ফলে অতিরিক্ত টাকা দিয়েও অনেক গ্রাহক খুঁটি বা সংযোগ পাচ্ছেন না। চক্রটি অন্য ঠিকাদারদের কাজ করতেও বাধা দিচ্ছে, পিডিবির কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় পুরো এলাকা কার্যত তাদের দখলে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
খুঁটি বাণিজ্যের খপ্পরে সর্বস্বান্ত শত শত মানুষ
সন্দ্বীপের বাসিন্দা আল মাহমুদ সাইমন বলেন, “আওয়ামী লীগের সময় থেকে এই মুন্না খুঁটি বাণিজ্যে জড়িত। সে প্রায় ৯০ লাখ টাকার বিদ্যুতের তার পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। মানুষ দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হতে হতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তাকে গণধোলাই দিয়েছে।”
আরেক বাসিন্দা আরশাদ হোসেন জীবন বলেন, “এই মুন্না খুঁটি দেওয়ার কথা বলে সন্দ্বীপের মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করেছে। এখন মানুষ প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে।”
স্থানীয় গৃহবধূ রেশমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, “আমার শ্বশুরের কাছ থেকে খুঁটির জন্য টাকা নিয়েছে মুন্না। অথচ এখনো খুঁটি পাইনি। সরকার বিনামূল্যে খুঁটি দিয়েছে, কিন্তু সে চাঁদাবাজি করেছে।”
ঘটনার পর থেকে মিলাদ উদ্দিন মুন্না আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা থেকে হঠাৎ ‘সমন্বয়ক’
নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সন্দ্বীপ উপজেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ আজাদ অভিযোগ করেন, ‘মুন্নাকে বিদ্যুৎ বিভাগের ঠিকাদার হিসেবে জানতাম। শুরুতে ভাবতাম, সে নিয়মমাফিক দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু পরে দেখি, যেসব পরিবার একেকটি পিলারের জন্য ১০ হাজার টাকা দিচ্ছে, শুধু তাদের বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ যাচ্ছে। যারা টাকা দেয়নি, তাদের আবেদন পড়ে থাকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুন্নার সাথে কথা বললে সে বলত, আওয়ামী লীগ করে, ছাত্রলীগকে পছন্দ করে। দাবি করত, তার মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমার বাড়িতে চারটি পিলার বসানোর কথা থাকলেও সে মাত্র দুটি বসিয়ে চলে যায়। পরে তার এক লেবারের মাধ্যমে জানায়, অতিরিক্ত খরচ দিলে বাকি পিলারগুলো বসানো যাবে। আমি ২৫ হাজার টাকা দিই, কিন্তু আর কোনো সাড়া পাইনি।’
আজাদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাগিনা, কখনো সাংবাদিক আবার কখনো স্বেচ্ছাসেবক লীগ পরিচয়দানকারী মুন্না গত বছরের ৫ আগস্ট সন্দ্বীপ বিদ্যুৎ অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও অবমাননাকর আচরণ করে। এ ঘটনার পরেও কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।’
প্রেসক্লাবের পরিচয়ে অপকর্ম
চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আবদুল্লাহ আল টিটু জেলা প্রশাসক বরাবর এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, ‘মিলাদ উদ্দিন মুন্না নিজেকে অনলাইন সাংবাদিক পরিচয়ে আগের সরকারের নাম ভাঙিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করত। সাংবাদিকতার আড়ালে সে পিডিবির কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে। এখন সে আবার নিজেকে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিলাদ উদ্দিন মুন্না নামের কেউ আমাদের প্রেসক্লাবের সদস্য নয়। গত বছরের আগস্টে সংঘবদ্ধ একটি চক্র প্রেসক্লাব দখলের চেষ্টা করে, এরপর থেকেই অনেক চিহ্নিত অপরাধী নিজেদের প্রেসক্লাব সদস্য পরিচয় দিয়ে নানা অপকর্ম করছে।’
প্রেসক্লাব লুটপাটে ছিলেন লোহার রড হাতে
২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংঘটিত হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় মিলাদ উদ্দিন মুন্নার নাম উঠে আসে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে থাকা একটি ভিডিও ফুটেজে তাকে লোহার রড হাতে প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ওই হামলায় অন্তত ২০ জন সাংবাদিক আহত হন। বিএনপি-জামায়াতপন্থি একদল দুর্বৃত্ত প্রেসক্লাবের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে হামলা চালায়। তাদের মধ্যে মাদক, ধর্ষণ মামলার আসামি ও ভূমিদস্যুরাও ছিল। তারা সাংবাদিকদের মারধর করে। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল সাংবাদিকদের উদ্ধার করে।
প্রেসক্লাবের সদস্য পরিচয়ে ভয়ঙ্কর সব অপকর্মে দুর্বৃত্তরা
৫ জুন চট্টগ্রামের একটি গেস্ট হাউসে চাঁদাবাজির অভিযোগে ধরা পড়েন এম হান্নান রহিম তালুকদার নামের এক প্রতারক। নিজেকে ‘চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য’ পরিচয় দিয়ে তিনি চাঁদা দাবি করেন। ফেসবুকে তিনি নিজেকে দৈনিক চট্টগ্রাম সংবাদ-এর সম্পাদক, সিএসটিভি২৪-এর চেয়ারম্যান এবং প্রেসক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিতেন, যদিও সব পরিচয়ই মিথ্যা ও ভুয়া।
তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ১৬ জুন কোতোয়ালী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। সাংবাদিক ও যুবদল নেতা পরিচয়ে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামে তিন শতাধিক অবৈধ ট্যাক্সি চালাতেন এবং মাসোহারা তুলতেন।
২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে হামলার ঘটনায় তার নামও ওঠে আসে। পরে তাকে প্রেসক্লাবের ‘আহ্বায়ক’ দাবি করা জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও ‘সদস্য সচিব’ জাহিদুল করিম কচিসহ একাধিক অনুষ্ঠানে দেখা গেছে।
সিপি