কর্ণফুলীতে প্রশাসনের গোপন কক্ষে ‘সিএ’ পরিচয়ে বহিরাগত যুবকের দাপট, তথ্য ফাঁসের গুঞ্জন
সরকার পতনের পর এসেছে তিন ইউএনও, ব্যবস্থা নেননি কেউ
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক কক্ষে প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ততা। কিন্তু অবাক করা বিষয়—যিনি কক্ষের টেবিল-চেয়ার দখল করে অফিসিয়াল কাজ সামলাচ্ছেন, তিনি সরকারি কোনো কর্মচারী নন। কোনো সরকারি নিয়োগপত্র নেই তার, নেই কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের বিগত দিনের সরকারি বাজেট বা বেতনভাতার তালিকায়ও নাম নেই। তারপরও দিব্যি গোপন শাখায় বসে দায়িত্ব পালন করছেন বছরের পর বছর।
সেই দাপুটে ব্যক্তির নাম মো. ইমতিয়াজ উদ্দীন। তিনি সাবেক বড়উঠান এলাকার শাহমীরপুরের বাসিন্দা।
এনিয়ে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। সাধারণ সেবাপ্রত্যাশীরাও পড়ছেন বিড়ম্বনায়। প্রশ্ন উঠেছে—কার নির্দেশে ও কী প্রভাবে প্রশাসনের মতো একটি স্পর্শকাতর দপ্তরে বহিরাগত এক যুবক এতটা প্রভাব বিস্তার করছেন?
যেভাবে প্রশাসকের গোপন কক্ষে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইমতিয়াজ উদ্দীন ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী। থাকেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশেই বড়উঠানের শাহমীরপুর। চেয়ারম্যান থাকার সময় তিনি গোপনীয় নথি, প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও প্রশাসনিক নানা কাজে যুক্ত ছিলেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে নিয়মিতভাবেই তাকে উপজেলা পরিষদে দেখা যেত। এমনকি নিজেকে ‘কনফিডেনসিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট (সিএ)’ পরিচয় দিয়ে গোপন নথি প্রক্রিয়াজাত করার কাজও করেছেন। অথচ উপজেলা পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামোয় ‘সিএ’ নামে কোনো পদ নেই।
ফারুক চৌধুরী ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে যাওয়ার পরও বহাল তবিয়তে অফিস করছেন এই ইমতিয়াজ। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের গোপনীয় কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, নিজের নামে সরকারি লোগোযুক্ত নেমপ্লেট লাগিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসে কাজ করছেন তিনি। সাংবাদিক দেখে একবার কক্ষ থেকে বের হন। আরেকবার প্রবেশ করেন। কিছুতেই স্থির ছিলেন না। নতুন উপজেলা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার ১৬ নম্বর কক্ষে রাজত্ব তার!
আমরা কোণঠাসা, অভিযোগ কর্মকর্তাদের
সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত ইউএনও কার্যালয়ের অন্য কর্মচারীরা অকপটেই স্বীকার করেছেন, ‘হ্যাঁ, ইমতিয়াজ দীর্ঘদিন ধরে উপজেলায় অফিসে কাজ করছেন।’ তবে তার কোনো সরকারি পদ বা নিয়োগ নেই বলেও জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই যুবকের দাপটে আমরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। সে এমন ভঙ্গিতে কাজ করে, যেন সবার ঊর্ধ্বে। কিছু বলতে গেলেও নানান সমস্যায় পড়তে হয়।’ আরেকজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ‘আমাদের আশঙ্কা, প্রশাসনের গোপন নথি পর্যন্ত বাইরে চলে যাচ্ছে।’
সেবাপ্রার্থীরাও অবাক
শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নন, সাধারণ মানুষও বিস্মিত। চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের হাশেম নামের এক সেবাপ্রার্থী বলেন, ‘উপজেলা পরিষদে একটা দরখাস্ত জমা দিতে গিয়েছিলাম। দেখি, সরকারি কর্মচারী নয়, বহিরাগত একজন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তার আচরণ দেখে মনে হয়েছে, তিনি যেন এই অফিসের মালিক।‘ চরপাথরঘাটার নিজাম উদ্দিনের ভাষায়, ‘অফিসে ঢুকেই তার সঙ্গে খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। মনে হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা যেন তাকে ভয় পান।’
নথি উধাও হওয়ার রহস্য
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা এলজিইডি ও প্রকল্প দপ্তর থেকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নথি ও ফাইল উধাও হয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের বাজেট, প্রকল্প অনুমোদনপত্র এমনকি দুদকের তদন্তের জন্য তলব করা কিছু কাগজপত্র পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলা চেয়ারম্যানের নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মালামাল ক্রয় ও পছন্দের একই ইউপি সদস্যকে দেওয়া শত শত প্রকল্পের নথি গায়েব বলে অভিযোগ। এসব ঘটনার পেছনে ইমতিয়াজের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে। কারণ দুদকে একাধিক অভিযোগ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। আর তার ‘সিএ’ বলে পরিচয় দেওয়া ইমতিয়াজ এখনও উপজেলা পরিষদে বহাল।
উপজেলার একাধিক কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবার ইউএনও বদলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমতিয়াজ আবার নতুন করে জায়গা করে নেন। অথচ কোনো ইউএনওই তার নিয়োগ বা বেতনভাতার উৎস খোঁজার উদ্যোগ নেননি।
বেতন তালিকায় নাম নেই
উপজেলা পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামোতে জায়গা করে নিয়ে ইমতিয়াজ ‘সিএ’ পরিচয়ে কাজ করলেও। সরকারি বাজেট, বেতন তালিকা বা ওয়েবসাইট—কোথাও ইমতিয়াজের নাম নেই। এমনকি ২০১৯ হতে ২০২৪ সালের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নিয়মিত কর্মচারীর তালিকা ও বেতন বিবরণীতেও তার অস্তিত্ব নেই। একজন প্রাক্তন ইউএনও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে জানান, ‘চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী হয়তো তার ব্যক্তিগত অর্থে বেতন দিতেন। কিন্তু সরকারি কাঠামোয় তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এখনো নেই।’
নীরব প্রশাসন
নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব কান্তি রুদ্র মাত্র ২৯ দিন হলো কর্ণফুলীতে যোগ দিয়েছেন। তিনি বিষয়টি এত অল্প সময়ে জানার কথা না। তবে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ইউএনও মাসুমা জান্নাত ও নাছরীন আখতারও কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি তারা জেলা প্রশাসককে অবহিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব কান্তি রুদ্র বলেন, ‘আমি এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। আমরা লিখিত অভিযোগ না পেলে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
গোপন তথ্য ফাঁসের শঙ্কা
সরকারি কাঠামোয় যার কোনো অস্তিত্ব নেই, পরিষদের বাজেটে যিনি নেই, অথচ মাসের পর মাস উপজেলা পরিষদের মূল কক্ষে বসে গোপন নথি সামলাচ্ছেন—এটি নিঃসন্দেহে বড় ধরনের প্রশাসনিক অনিয়ম। শুধু তাই নয়, এতে গোপন তথ্য ফাঁস ও প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির আশঙ্কাও জোরালো হচ্ছে। পরিষদ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিও তৈরি করছে। উপজেলা পরিষদের ভেতরের তথ্য যদি বাইরে চলে যায়, তাহলে ক্ষতি মারাত্মক হবে।
ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, দাবি অভিযুক্তের
এমন অভিযোগের বিষয়ে মো. ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘আমি এস আলম গ্রুপে সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতাম। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে লিখিত পরীক্ষা এবং ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি এই জায়গায় এসেছি। আমি কোনো অনিয়ম করে এই চাকরি পাইনি। আমি এমন একটা পদে চাকরি করি, যেখানে আমার পক্ষে সবার মন রাখা বা সবার পক্ষ নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই আমার বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’
জেজে/ডিজে