চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার ‘ভুয়া সাংবাদিক’ সেই যুবদল নেতা, গেস্ট হাউসে চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা

চট্টগ্রামে এক প্রতারক সাংবাদিকের ছদ্মবেশে গেস্ট হাউসে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন তিনি। ধরা পড়া এই ব্যক্তি যুবদল নেতা এম হান্নান রহিম তালুকদার, যিনি নিজেকে ফেসবুকে একাধারে দৈনিক চট্টগ্রাম সংবাদ-এর সম্পাদক, সিএসটিভি২৪-এর চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার এসব পরিচয় মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। তার বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেই একাধিক মামলা ছিল, এবার সরাসরি প্রতারণা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন তিনি। তবে কয়েকজন কথিত সাংবাদিক নেতা তাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

গত ১ মে আনোয়ারায় পারকি বিচে চট্টগ্রামের পেশাদার সাংবাদিকদের পিকনিক বানচাল করতেও হান্নান রহিমসহ কয়েকজন দুর্বৃত্তকে দিয়ে মানববন্ধন আয়োজনের চেষ্টা করা হয়।
গত ১ মে আনোয়ারায় পারকি বিচে চট্টগ্রামের পেশাদার সাংবাদিকদের পিকনিক বানচাল করতেও হান্নান রহিমসহ কয়েকজন দুর্বৃত্তকে দিয়ে মানববন্ধন আয়োজনের চেষ্টা করা হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (১৬ জুন) রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশের একটি দল। অভিযানে নেতৃত্ব দেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আফতাব উদ্দিন।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) একাধিক অনুষ্ঠানে দেখা গেছে ভুয়া সাংবাদিক হান্নান রহিম তালুকদারকে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) একাধিক অনুষ্ঠানে দেখা গেছে ভুয়া সাংবাদিক হান্নান রহিম তালুকদারকে।

হান্নান রহিম তালুকদার (৪১) চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া গ্রামের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে বসবাস করেন চান্দগাঁওয়ের খরমপাড়া ডিপুটি আবাসিক রোডে অবস্থিত ‘হান্নান ভিলা’তে।

২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে সংঘটিত হামলা ও লুটপাটের ঘটনায়ও হান্নান রহিম তালুকদারের নাম ওঠে আসে।
২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে সংঘটিত হামলা ও লুটপাটের ঘটনায়ও হান্নান রহিম তালুকদারের নাম ওঠে আসে।

তবে তার নামের সঙ্গে আরও নানা বিতর্ক জড়িত। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা (এফআইআর নং-৭) ছাড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চান্দগাঁও থানায় (এফআইআর নং-৩৪) এবং আনোয়ারা থানার সিআর মামলা (নং-২১০৭/২১) রয়েছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সঙ্গে ভুয়া সাংবাদিক এম হান্নান রহিম তালুকদার।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সঙ্গে ভুয়া সাংবাদিক এম হান্নান রহিম তালুকদার।

জানা গেছে, সাংবাদিক ও যুবদল নেতা পরিচয় দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে হান্নান রহিম তালুকদারের নামে তিন শতাধিক অবৈধ ট্যাক্সি চলাচল করে। তিনি এসব ট্যাক্সি থেকে নিয়মিত মাসোহারা তোলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কী ঘটেছিল রাতে?

৫ জুন রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার ‘পপুলার গেস্ট হাউজ’-এ হান্নান রহিম ও তার সহযোগীরা সাংবাদিক পরিচয়ে প্রবেশ করেন। এরপর ক্যামেরা হাতে বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে তল্লাশি চালান এবং অতিথিদের মুখোমুখি জেরা শুরু করেন। কারা এসেছে, কী উদ্দেশ্যে হোটেলে উঠেছে, তারা স্বামী-স্ত্রী কি না, এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে অতিথিদের বিব্রত ও আতঙ্কিত করেন।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল—ভয় দেখিয়ে হোটেলের মালিকপক্ষ থেকে চাঁদা আদায় করা। তারা হুমকি দেন, চাঁদা না দিলে হোটেলের বিরুদ্ধে ‘নেগেটিভ নিউজ’ প্রকাশ করবেন এবং ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

তল্লাশির পুরো ঘটনাটি ক্যামেরায় ধারণ করে পরে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করেন হান্নান রহিম নিজেই। ভিডিওটি ছিল ১৫ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড দীর্ঘ এবং ফেসবুকে পোস্ট হতেই তা ভাইরাল হয়ে পড়ে।

ভিডিওতে দেখা যায়, হান্নান রহিম সরাসরি রিসিপশনে গিয়ে রেজিস্টার খাতা যাচাই করছেন, আবার একাধিক কক্ষে গিয়ে অতিথিদের বের করে এনে তাদের পরিচয় জানতে চাইছেন। এক ব্যক্তি জানাচ্ছেন, তিনি স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে এনেছেন। তবুও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আবার প্রশ্ন করা হয়, “আপনারা সত্যিই স্বামী-স্ত্রী তো?”

আরেক কক্ষে দেখা যায়, এক তরুণ ও তরুণীকে জেরা করছেন তিনি। দুজনই নিজেদের বিবাহিত বলে দাবি করলেও রহিম বলেন, “আপনাদের বিয়ে হয়নি, আমরা তথ্য নিয়ে এসেছি।”

থানায় মামলা, তদন্ত শুরু

ঘটনার পর গেস্ট হাউসটির এক স্টাফ জাকির হোসেন চান্দগাঁও থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন। মামলা (নং-২০) দায়ের হয় পেনাল কোডের ১৪৩, ৪৪৮, ৩৮৫ ও ৫০৬ ধারায়। এরপর থেকেই রহিমকে ধরতে মাঠে নামে পুলিশ।

চান্দগাঁও থানার ওসি আফতাব উদ্দিন বলেন, “সাংবাদিক পরিচয়ে কেউ হোটেলে গিয়ে কক্ষ তল্লাশি করতে পারে না। অভিযোগ থাকলে সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার শুধুই পুলিশের।”

‘ভুয়া পরিচয়’ ফাঁস, প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের বক্তব্য

ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেন—‘সাংবাদিক পরিচয়ে এমন তল্লাশি কি কোনোভাবেই বৈধ?’

অনুসন্ধানে জানা যায়, হান্নান রহিম যেসব পরিচয় দিচ্ছেন, তার অধিকাংশই ভুয়া। হান্নান রহিম নিজেকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য হিসেবে দাবি করলেও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন রেজা বলেন, “এই নামে আমাদের সদস্য তালিকায় কেউ নেই।”

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ জানান, “হান্নান রহিম তালুকদার আমাদের ইউনিয়নের সদস্যও নন। তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজের পরিচয় বানিয়েছেন।”

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একাধিক ছবি রয়েছে যেখানে তাকে বিএনপি ও যুবদল নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে। নিজেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সদস্যসচিব প্রার্থী বলেও বিভিন্ন ব্যানার ও পোস্টারে দাবি করেছেন তিনি।

আগেও বিতর্কে ছিলেন

২০২৪ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে সংঘটিত হামলা ও লুটপাটের ঘটনায়ও তার নাম উঠে আসে। পরে তাকে প্রেসক্লাবের ‘আহ্বায়ক’ দাবিদার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও ‘সদস্য সচিব’ জাহিদুল করিম কচির সঙ্গে ছাড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) একাধিক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে।

বর্তমানে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, যা তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে।

জেজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm