চট্টগ্রামের অপহরণকাণ্ডে ফুটেজ, সাক্ষী, কালো গাড়ি—সব থেকেও পুলিশের হাতে ‘প্রমাণ নেই’

মূল রহস্য আড়াল করে পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্ট

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ব্যবসায়ী শহিদুল আলম জুয়েলকে অপহরণের ঘটনার সাত মাস ২৯ দিন পর ‘তদন্ত শেষ’ ঘোষণা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠিয়েছে কর্ণফুলী থানা–পুলিশ। সময়ের ব্যবধান, সিসিটিভি ফুটেজ, গাড়ির নম্বর, মোবাইল লোকেশন—সব তথ্য হাতে থাকার পরও পুলিশ বলছে, ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই’। পরিবারের অভিযোগ, প্রকৃত পরিকল্পনাকারীদের নাম আড়ালে রেখে মামলাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাতে সত্য চাপা পড়ে যায়।

অপহরণকারীদের মুখ–চেহারা, তাদের ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর—সবই দেখা গেছে। পরিচিত প্রাইভেট কার, সিএনজিও সনাক্ত। কিন্তু সেগুলোর জব্দ বা যাচাই–বাছাই পুলিশের তদন্তে নেই।
অপহরণকারীদের মুখ–চেহারা, তাদের ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর—সবই দেখা গেছে। পরিচিত প্রাইভেট কার, সিএনজিও সনাক্ত। কিন্তু সেগুলোর জব্দ বা যাচাই–বাছাই পুলিশের তদন্তে নেই।

পুলিশের ‘ফাইনাল রিপোর্ট’: নেই প্রমাণ, নেই আসামি

নৌ–পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই কে এম নাজিবুল ইসলাম তানভীর দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এজাহারে থাকা আট আসামির বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তদন্তে তাদের ‘অব্যাহতি’ চাওয়া হয়েছে। এজাহারের সেই আটজন হলেন মো. মাঈন উদ্দিন, মো. শাহেদুর রহমান শাহেদ, মির্জা আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক মেম্বার, জাফর আহমদ, মো. ইমরান পাটোয়ারী, আব্দুর শুক্কুর ও জহিরুল আলম। ঘটনার এক সপ্তাহ পর এক অনলাইন প্রতিবেদনে জানানো হয়, এজাহারের ব্যক্তিরা অপহরণের সঙ্গে জড়িত নন।

অপহরণের ঘটনায় ব্যবহৃত কালো প্রাইভেট কারটির নম্বর চট্ট মেট্রো–গ ১৪–৪৮৪১। তদন্ত কর্মকর্তা গাড়িটি জব্দ বা পরীক্ষা না করেই এড়িয়ে গেছেন।
অপহরণের ঘটনায় ব্যবহৃত কালো প্রাইভেট কারটির নম্বর চট্ট মেট্রো–গ ১৪–৪৮৪১। তদন্ত কর্মকর্তা গাড়িটি জব্দ বা পরীক্ষা না করেই এড়িয়ে গেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বাদীসহ পাঁচজন সাক্ষীর ১৬১ ধারায় বক্তব্য নেওয়া হলেও অপহরণের মুহূর্তে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এসআই তানভীর দাবি করেছেন, সিসিটিভি, মোবাইল লোকেশন বা কল ডিটেইলস—কোনো মাধ্যমেই এজাহারের আটজনের সম্পৃক্ততা মেলেনি। তবে একই প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, অপহরণ ‘সত্য’, কিন্তু অপরাধীরা কারা, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।

৩০ অক্টোবর কর্ণফুলী থানায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন অগ্রবর্তী করা হয়, যাতে ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর ছিল না।
৩০ অক্টোবর কর্ণফুলী থানায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন অগ্রবর্তী করা হয়, যাতে ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর ছিল না।

এরপরও উল্লেখ করা হয়েছে—‘অদূর ভবিষ্যতে আসামি শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ’। মামলাটি ৩৮৫/১০৯/৩৬৫ ধারায় দাখিল করা হলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই, এসব ধারায় অভিযুক্ত কারা। সিসিটিভিতে দেখা ব্যক্তিরা কারা, প্রাইভেট কারের মালিক কে, সিএনজি কোথা থেকে নেওয়া হলো—এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

পরিবার বলছে, অপহরণকারীদের মুখ–চেহারা, তাদের ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর—সবই দেখা গেছে। পরিচিত প্রাইভেট কার, সিএনজিও সনাক্ত। কিন্তু সেগুলোর জব্দ বা যাচাই–বাছাই তদন্তে নেই।

পরিবারের অভিযোগ: মূল পরিকল্পনাকারীরা আড়ালে

ভুক্তভোগীর পিতা শাহ আলম বলেন, রমজান মাসে তারাবির নামাজ শেষে মসজিদের সামনে থেকেই তার ছেলেকে তুলে নেওয়া হয়। পুলিশ উদ্ধার করেনি, বরং চাপ অনুভব করে অপহরণকারীরাই ছেড়ে দেয়। তার অভিযোগ, এজাহারের লোকজন জড়িত না—এটা প্রমাণ হলেও, আসল অপরাধীরা কারা, সেটা তদন্ত করেননি তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তদন্ত থামিয়ে প্রকৃত দোষীদের রক্ষা করা হয়েছে।’

পরিবারের অভিযোগ, তদন্ত কর্মকর্তা মাঠে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান না করে তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, আটজন নির্দোষ বলে প্রচার হওয়ার পর স্থানীয়ভাবে এমন কথাও ছড়ায় যে তদন্ত কর্মকর্তা ও তৎকালীন ওসিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদিও এসব স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার বিবরণ ও আগের অনুসন্ধান

গত ৫ মার্চ রাতে তারাবি শেষে ইছানগর জামে মসজিদের সামনে থেকে ৯–১০ জন যুবক ‘ছাত্র পরিচয়ে’ জুয়েলকে সিএনজিতে তুলে নেয়। তারপর তাকে শাহ আমানত সেতু, পুরাতন ফিশারিঘাট, লালদীঘি ও কাজীর দেউড়ি এলাকায় ঘোরানো হয়। ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়, পরে দাবি কমিয়ে ৫ লাখ, তারপর ৩ লাখ।

রাত আড়াইটার দিকে কাজীর দেউড়ির রয়েল হাট এলাকায় তাদের বহনকারী কালো প্রাইভেট কার থামে। কর্ণফুলী থানা–পুলিশ এলাকায় প্রবেশ করায় অপহরণকারীরা গাড়িটি ঘুরিয়ে চট্টগ্রাম নগরের রেডিসন মোড়ের ‘হল টোয়েন্টিফোর’ এর সামনে জুয়েলকে ছেড়ে দেয়। গাড়িতে থাকা কয়েকজনের নাম জুয়েল উল্লেখ করেন। এরপর তিনি রিকশায় কোতোয়ালী থানায় যান।

এ ঘটনার পরপর ১২ মার্চে প্রকাশিত চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওঠে আসে, অপহরণের বর্ণনা ও সিসিটিভি ফুটেজের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। তথ্যগত নানা গরমিলও সামনে আসে।

ঘটনার সাত দিন পর প্রকাশিত ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফুটেজে জুয়েল নিজে থেকেই সিএনজিতে ওঠেন। সিএনজি স্বাভাবিকভাবে মইজ্জ্যারটেক টোল প্লাজা অতিক্রম করে। সঙ্গে থাকা কালো প্রাইভেট কারটির নম্বর চট্ট মেট্রো–গ ১৪–৪৮৪১। এটি রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম কোদালার মোছাম্মদ রওশন আক্তার ও মোহাম্মদ মুছার মালিকানাধীন। গাড়িটি ভাড়া নয়, ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি। অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত কর্মকর্তা গাড়িটি জব্দ বা পরীক্ষা না করেই এড়িয়ে গেছেন।

সিএনজির তথ্যও উপেক্ষিত

সিএনজি অটোরিকশার মালিক শাহেদ আলী ইপিজেড লেবার কলোনির বাসিন্দা। চালক শরীফ জানান, কাজীর দেউড়ি থেকে তাকে ভাড়া করা হয়। তিনটি সিএনজি শহর থেকে চরপাথরঘাটা পর্যন্ত যায়। প্রতি সিএনজিতে ৭০০ টাকা করে মোট ২১০০ টাকা ভাড়া দেন অপহরণকারীরা।

চালকের দাবি, লালদীঘি মাঠ থেকে জুয়েলকে কালো প্রাইভেট কারে তোলা হয়, তার আগে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে নেয়। তবে পুরো সময় জুয়েল কোনো প্রতিরোধ করেননি। কিন্তু এই প্রত্যক্ষ তথ্য তদন্ত কর্মকর্তা নেননি। তাদের জবানবন্দি নথিতেও নেই।

মোবাইল লোকেশন বিশ্লেষণেও গরমিল

৬ মার্চ রাত ১টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত জুয়েলের ফোন বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান দেখায়—খুলশী, পাঁচলাইশ, লালখানবাজার, পরে কোতোয়ালী।
৬ মার্চ রাত ১টা ৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডে ভিকটিমের মোবাইল ট্র্যাক করা হলে অবস্থান পাওয়া যায় খুলশীতে। ১৫ মিনিট পর রাত ১টা ২১ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে তার অবস্থান পাঁচলাইশ, ৪ মিনিট পর ১টা ২৫ মিনিটে ইস্পাহানি মোড় লালখান বাজার, ১টা ২৯ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে কোতোয়ালী এবং ২টা ২১ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে আবার কোতোয়ালী এলাকায় পাওয়া যায়। সেখানে ২টা ৩৫ মিনিট ২ সেকেন্ড পর্যন্ত অবস্থানের তথ্যও পাওয়া গেছে।

জুয়েলের দাবি ছিল, তাকে ফিশারিঘাট–কাজীর দেউড়ি হয়ে কোতোয়ালী নেওয়া হয়। কিন্তু লোকেশন অনুযায়ী রাত ১টা থেকে ১টা ৩০’র মধ্যে তিনি শহরের ভিন্ন এলাকায় ছিলেন। এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা তদন্ত প্রতিবেদনে নেই।

তদন্তের অসঙ্গতি

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঘটনাস্থলের ছবি নেই, ফরেনসিক নেই, ফুটেজ বিশ্লেষণ নেই, সিসিটিভিতে দেখা ব্যক্তিদের মুখ বিশ্লেষণ নেই। অন্যদিকে সিএনজি বা প্রাইভেট কার জব্দ নেই, চালকদের বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ নেই, চেইন–অফ–কাস্টডি যুক্ত নেই আর এমনকি পুনঃতদন্তের ধারাও খোলা রাখা হয়নি।

অধিকতর তদন্তের দাবি

জুয়েলের পরিবার চায় মামলাটি পিবিআই, সিআইডি বা ডিবির কাছে যাক। শাহ আলম জানান, তারা শিগগিরই নারাজি আবেদন দাখিল করবেন।

বিষয়টি সম্পর্কে নজর রাখছেন, চট্টগ্রামের এমন এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলেন, ফরেনসিক ও ফুটেজ যাচাই না করে ‘ঘটনা সত্য, কিন্তু প্রমাণ নেই’ বলা তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

তদন্ত কর্মকর্তা, পুলিশ, আইনজীবীর বক্তব্য

ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী শহিদুল আলম জুয়েল জানান, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তানভীর ঘটনাস্থলে আসার কথা ছিল। একবার ফোনও করেছিলেন, কিন্তু আর আসেননি। পরে শুনছি তিনি ফাইনাল রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। সাবেক ওসি শরীফ একদিন রাতে কল করে একজনের ছবি পাঠিয়েছিলেন—তাকে আমি চিনি কি না জানতে চান। আমি বলি, হ্যাঁ, এই ছেলেটি আমাকে অপহরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গাড়িতেই ছিল। কিন্তু পরে ওসি জানান, বিভিন্ন চাপের কারণে ‘মুচলেকা’ নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ছেলেটিকে স্পষ্টভাবে চিনি।’

জুয়েলের বাবা শাহ আলম বলেন, ‘এই প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। সত্য জানার আগেই তদন্ত শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’

এসআই তানভীর বলেন, ‘যা পেয়েছি প্রতিবেদনে লিখেছি, এর বাইরে আর কিছু বলব না।’

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফ-এর মহাসচিব জিয়া হাবীব আহসান জানান, সুযোগ থাকার পরও অপরাধী শনাক্ত না হলে বাদী নারাজি দিতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন।

কর্ণফুলী থানার ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সব অফিসার একইভাবে কাজ করতে পারে না।’

নবাগত ওসি জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘বাদী অসন্তুষ্ট হলে নারাজি দিতে পারবেন।’

কর্ণফুলী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আগে জানতাম না। চার্জশিট পর্যালোচনা করে দেখেছি। বাদী চাইলে নারাজি দিতে পারবেন।’

চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া

৩০ অক্টোবর থানায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন অগ্রবর্তী করা হয়। ওসি জাহিদুল ইসলাম তা পাঠান। প্রতিবেদনে ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর ছিল না। ৫ নভেম্বর কোর্ট প্রসিকিউশন গ্রহণ করে। পরদিন তা আদালতে উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) প্রসিকিউশন মো. মফিজ উদ্দিন।

জেজে/সিপি

ksrm