সাতকানিয়ার পাহাড়ে ভয়ঙ্কর অপহরণ চক্র: ব্যবসায়ীরা টার্গেট, মুক্তি শুধু মুক্তিপণে!
রাতে ব্যবসায়ী অপহরণের পরের ২৪ ঘণ্টায় যা ঘটল
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা প্রায়ই লোকালয় থেকে লোকজনকে অপহরণ করে পাহাড়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করছে। এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি এবং চাঁদাবাজির ঘটনাও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে গেছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে গোপনে, যেখানে মূল টার্গেট ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের পরিবার। ভুক্তভোগীরা ছাড়া পেয়েও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ অপহরণকারীরা রাজনৈতিক দলের বড় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে। এমন ঘটনায় গত ৬ মার্চ ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক নামের দুই জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।

বালি ব্যবসায়ী অপহরণে ৩০ লাখ মুক্তিপণ!
এদিকে সর্বশেষ এক ঘটনায় জহির উদ্দিন মিন্টু নামে এক বালি ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মারধর ও ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। জায়গা ভরাটের কথা বলে ডেকে নিয়ে ৫২ বছর বয়সী ওই ব্যবসায়ীকে পার্শ্ববর্তী আউল্লা ঘোনা পাহাড়ে অপহরণকারীদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিপণের স্বর্ণ নিতে সমতলে আসার পর ভোরে যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে দুর্বৃত্তরা তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। বুধবার (১১ জুন) অপহৃত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ভোরে কাঞ্চনা স্লুইচ গেইট এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।

বুধবার (১১ জুন) সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভকিয়ার পাড়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। অপহরণের শিকার জহির উদ্দিন মিন্টু নলুয়া ইউনিয়ন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গার আব্দুল কাদেরের ছেলে। তিনি নলুয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।

‘জায়গা ভরাট’ নয়, ছিল অপহরণের ফাঁদ!
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অপহরণের শিকার জহির উদ্দিন মিন্টু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জায়গা ভরাট করার কথা বলে শেষে ৯০৫— এমন একটি নাম্বার থেকে ফোন করেন একজন। বুধবার (১২ জুন) আমি ও আমার ভাই সোহেল মোটরসাইকেল নিয়ে জায়গাটি দেখতে এওচিয়া ইউনিয়নের ভকিয়ার পাড়ায় যাই। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর একদল লোক এসে প্রথমে আমাদের মারধর করে। এর এক পর্যায়ে তারা আমাদের চোখও বেঁধে ফেলে। কিছুক্ষণ পর তারা আমার ভাই সোহেলকে ছেড়ে দেয়। তাদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক ছিল। এ অবস্থায় তারা আমাকে পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে তারা প্রথমে কারেন্টের শক দেয়।’
মিন্টু বলেন, ‘এরপর দফায় দফায় তারা আমাকে মারধর করে। কখনও লোহার স্টিক দিয়ে, আবার কখনও বন্দুকের বাট দিয়ে। সাত থেকে আটজন সেখানে ছিল। সবার হাতেই বন্দুক দেখেছি। তারা রাত থেকে আমার মোবাইল থেকে আমার স্ত্রীর মোবাইলে বারবার ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে আমার সামনেই। প্রথমে ৩০ লাখ টাকার জন্য অনেকক্ষণ কথা চালাচালির পর এরপর ২০ লাখ টাকায় নামে। সবশেষ ১৫ লাখ টাকা না দিলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার কথা জানায়।’
লাইভ লোকেশন ট্র্যাকিং, গহনা নিয়ে রওনা স্ত্রীর
উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানায়, ‘অপহরণকারীরা সর্বশেষ রাত তিনটার দিকে পাঁচ ভরি স্বর্ণ নিয়ে মিন্টুর স্ত্রীকে কাঞ্চনা স্কুলের কাছে যেতে বলে। তারা একটি গাছের বর্ণনা দিয়ে জানায়, স্বর্ণগুলো তার নিচে রাখতে হবে। এর মধ্যেই মিন্টুর স্ত্রী কয়েক ভরি স্বর্ণ ও ইমিটেশনের গহনা নিয়ে রওনা হন। এ সময় তার মোবাইলে গুগলের লাইভ লোকেশন সেবা চালু রাখা হয়। সন্দেহভাজনদের কয়েকটি মোবাইল নাম্বারও ট্র্যাকিংয়ে রাখে প্রশাসন।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফজরের আজানের পর জহির উদ্দিন মিন্টু পাহাড় থেকে নামিয়ে আনে অপহরণকারীরা। এর মধ্যেই ভোর পাঁচটার দিকে কাঞ্চনা কাজীর মসজিদের কাছে দুটি সিএনজিচালিত ট্যাক্সির গতিবিধি শনাক্ত করে যৌথবাহিনী। অপহরণকারীরা এ সময়ই মূলত যৌথবাহিনীর উপস্থিতি টের পায়। তারা মিন্টুকে ফেলে নিজেরা দ্রুত আশেপাশে সরে পড়ে।
জহির উদ্দিন মিন্টু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি টের পাই আমার আশেপাশে কেউ নেই। তখন আমি হাত ও পায়ে বাধা রশিগুলো ধীরে ধীরে খুলে ফেলি। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাঞ্চনা ফুলতলা এলাকায় হঠাৎ সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি দেখতে পাই। এরপর তাদের ঘটনা খুলে বলি। ওই সময় গাড়িতে একজনকে আটক অবস্থায় দেখি। সেনাসদস্যরা আমাকে জিজ্ঞেস করে তাকে চিনি কিনা। আমি চিনি না বলে জানাই।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, অপহৃত মিন্টুর খোঁজে ভোর রাতে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় ক্যাডার জাহিদ খানের বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। ওই সময় প্রতিবেশী একজনের বাড়ি থেকে জাহিদকে আটক করা হয়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জহির উদ্দিন মিন্টু বলেন, ‘পরে আমি জানতে পারি, জায়গা ভরাট করার কথা বলে জাহিদ খানই আমাকে ফোন করেছিলেন।’
অপহরণচক্রের পেছনে কারা?
স্থানীয় একাধিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপহরণকারী চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন জাহিদ খান ও দেলোয়ার। পদে না থাকলেও তারা দুজনেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত এবং চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এওচিয়া ও কাঞ্চনা এলাকায় অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মূল হোতাদের অন্যতম হলেন এওচিয়ার স্থানীয় জামায়াত নেতা আবু তাহের আদাইয়া, রিফাত এবং চুড়ামনি এলাকার দেলোয়ার। অপহরণের পর অধিকাংশ ভুক্তভোগীকেই পাহাড়ের ভেতরে তাদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারাই মূলত ঠিক করে দেন মুক্তিপণ ও নির্যাতনের মাত্রা। গত ৬ মার্চ ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক নামের দুই জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে মারার পর চূড়ামনি ও ছনখোলার বিশাল পাহাড়ি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় দেলোয়ারের হাতে। অন্যদিকে আগে থেকেই এলাকায় ত্রাস ছিলেন আবু তাহের আদাইয়া ও রিফাত।
তাদের পক্ষে মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দেন এওচিয়া ৩ নম্বর ওয়ার্ড খান বাড়ির জাহিদ খানসহ আরও কয়েকজন। তাদের অন্যতম সহযোগী ড্রাইভার বকশীরখীলের হেলাল, যার সিএনজি ট্যাক্সিটি প্রায়ই অপহরণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সহযোগীদের মধ্যে আরও রয়েছেন— গুরগুরির ইকবাল, মনু ফকিরহাটের আলমগীর, বকশীরখীলের ওসমান, সাদেক, পূর্ব ছনখোলার আতাউল করিমসহ কয়েকজন।
পাহাড়ে আস্তানা, হাতবদল মুক্তিপণে, নেতৃত্বে ‘চেনা মুখ’
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জোটপুকুরিয়া-ফুলতলা বাজারের বহু ব্যবসায়ী এই চক্রের শিকার হয়েছেন। কয়েক মাস আগে জোটপুকুরিয়া বাজারে শত শত মানুষের সামনে থেকে পল্লী চিকিৎসক রতন ডাক্তারকে প্রকাশ্যে সিএনজিতে তুলে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে চুড়ামনির দেলোয়ারের হেফাজতে নেওয়া হয়। সেখানে লোহার রড দিয়ে পল্লী চিকিৎসককে নির্মমভাবে পেটানো হয়। পরে দেড় লাখ টাকা অপহরণকারীদের হাতে তুলে দিয়ে ছাড়া পান তিনি। রতন ডাক্তার এখনও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার চেম্বারও সেই থেকে বন্ধ। অপহরণের এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন জাহিদ খান ও তার সহযোগীরা। সর্বশেষ গত রোববার রাতেও ফুলতলা বাজারের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের চেষ্টা চালান জাহিদ ও তার সহযোগীরা। পরে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও ওই ব্যবসায়ীকে প্রচণ্ড মারধর করা হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
একইভাবে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর এওচিয়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ আলম মেম্বারের ভাই দিদারকে মাদার্শার কামারের ভাঙ্গা থেকে অপহরণ করে ফুলতলার পাশে দক্ষিণ কাঞ্চনার গুরগুরি পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে তাকে ছাড়া হয়।
জাহিদ খানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় জাহিদ খানই ফোন করে জায়গা ভরাটের কথা বলে ডেকে নিয়ে যায় বলে জানান অপহরণের শিকার জহির উদ্দিন মিন্টু। সপ্তাহ কয়েক আগে এওচিয়া ইউনিয়নের মহিলা সদস্য তসলিমা আকতার মুন্নী চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে থানায় অভিযোগ করেন জাহিদসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে আতাউল করিমও অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, মিন্টুকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার পর রাতে সবার জন্য রান্না হয়েছিল আতাউলের বাড়িতে। গভীর রাতে সেখানে খাওয়ার কথা থাকলেও পরে সিদ্ধান্ত বদলে দুই-তিনজন সহযোগী নিয়ে আতাউল নিজেই রান্না করা খাবার নিয়ে পাহাড়ে অপহরণকারীদের ডেরায় যান। সকালে বেচে যাওয়া কিছু খাবার প্রতিবেশীদের বাড়িতেও পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আতাউলের মোবাইল ট্র্যাক ও কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখলেও এই অপহরণকারী চক্রের হদিস বের করা সম্ভব হতে পারে।
সন্ধ্যায় আতাউল করিমের মোবাইলে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
অপহরণকারীদের বাঁচাতে মাঠে প্রভাবশালীরা
এদিকে সেনাবাহিনীর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জামায়াত ‘ক্যাডার’ জাহিদ খান সকাল নয়টার দিকে ফেসবুকে লাইভে এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। অপহৃতদের কাউকে তিনি চেনেন না বলে জানান। জাহিদ খান সাতকানিয়া পুলিশ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলেও দাবি করেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত নেতারা জাহিদসহ অভিযুক্তদের রক্ষায় প্রশাসনের ওপর চাপ দিচ্ছেন—এমনকি ভুক্তভোগী মিন্টুকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টাও চলছে। তবে ওই সূত্র এও জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সাতকানিয়া থানা পুলিশকে চাপ দেওয়া হয়েছে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের জন্য।
সিপি