চট্টগ্রামে যুবদল নেতাকে ‘দখলবাজ’ সাজিয়ে কোটি টাকার জায়গা হাতানোর ফাঁদ ভূমিদস্যু চক্রের

চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টলীতে একটি জায়গা নিয়ে অভিনব ফাঁদ পেতেছে ভূমিদস্যুরা। সেই ফাঁদে এক যুবদল নেতাকে কখনও দখলবাজ, আবার কখনও বানাচ্ছে চাঁদাবাজ। মূলত কোটি টাকার ওই জমি হাতিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুদের ওই চক্র।

জানা গেছে, চক্রটির সদস্যরা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই পরিচিত। তাদের এমন চেষ্টা রুখতে নগর যুবদলের সাবেক সহসভাপতি শাহেদ আকবর পাঁচ বছর ধরে মামলা লড়ছেন। মামলা তুলে নিতেই এমন দখলদার ও চাঁদাবাজ সাজিয়ে এমন নাটক—জানালেন যুবদল নেতা শাহেদ আকবর। 

আরও জানা গেছে, রাজনৈতিক চরিত্র হননের মাধ্যমে এই যুবদল নেতাকে কোণঠাসা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি চক্র। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, নেপথ্যে রয়েছে কোটি টাকার জমি-কাণ্ড। মূলত জমিটি হাতিয়ে নিতেই যুবদল নেতা শাহেদকে চাঁদাবাজ ও দখলবাজ বানাতে নাটক সাজায় একটি ভূমিখেকো চক্র।

চক্রের অন্যতম সদস্যরা হলেন—দক্ষিণ পাহাড়তলী ঝর্ণা পাড়া এলাকার মাহাবুবুল আলম, উত্তর আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলাম, পাহাড়তলী সরাই পাড়া এলাকার নাছির আহম্মদ ও  আকবরশাহ লতিফপুর এলাকার রনি। তারা এলাকায় কিশোর গ্যাং লেলিয়ে ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, চক্রের অন্যতম সদস্য মাহাবুবুল আলম ও সাইফুল বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিশ্বস্তজন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সেসময় আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয়ে একের এক অপকর্মে লিপ্ত হন তারা। দখলবাজি, চাঁদাবাজিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন এলাকায়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা অসংখ্য ছবিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে তাদের হৃদ্যতার বিষয়টি উঠে আসে। এর মধ্যে সাইফুল ইসলাম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। চক্রের আরেক সদস্য মাহবুবুল আলম সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার সাথে তার সখ্যতার কথা জানা গেছে। এছাড়া আকবরশাহ এলাকায় রমরমা মাদক বাণিজ্য চালায় চক্রের আরেক সদস্য রনি। মাদকসেবী ও মাদক কারবারিদের সমন্বয়ে বড় এক অপরাধী চক্র রয়েছে তার। 

আরও জানা গেছে, শাহেদ আকবর চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সহসভাপতি। সামনে ঘোষিত হতে যাওয়া নগর যুবদলের কমিটিতেও গুরুত্বপূর্ণ পদে আলোচনায় রয়েছেন তিনি। এজন্য দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে তাকে ফাঁসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুদের একটি চক্র।

এদিকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি যুবদল নেতা শাহেদ আকবরের বিরুদ্ধে সাইনবোর্ড নাটক মঞ্চস্থ করে ভূমিখেকো চক্রটির সদস্যরা। জানা গেছে, উত্তর কাট্টলীর নিকুঞ্জ আবাসিকের একটি জমিতে যুবদল নেতা শাহেদ আকবরের নাম ও দলীয় পদপদবি লিখে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সাইনবোর্ডে লেখা হয়, দখলমূলে জায়গার মালিক যুবদলের সহসভাপতি শাহেদ আকবর। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না সাইনবোর্ডটি। জমিতে সাইনবোর্ডটির ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে তা বিভিন্ন ব্যক্তি ও গণমাধ্যমে সরবরাহ করেন ভূমিখেকো চক্রের অন্যতম সদস্য মাহাবুবুল আলম। সাংবাদিকদের কাছে তিনি নিজেকে জমির মালিক দাবি করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কেবল ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ধারণ করা পর্যন্তই ছিল সাইনবোর্ডটির অস্থিত্ব। এরপর তা সরিয়ে নেওয়া হয় দ্রুতই। মূলত শাহেদ আকবরকে দখলবাজ সাজাতেই এমনটি করে চক্রটি। মিডিয়া ট্রায়াল চালিয়ে রাজনৈতিক চরিত্র হনন করে চাপে ফেলতেই চক্রটির এমন প্রয়াশ বলে জানান শাহেদ আকবর।

উত্তর কাট্টলী নিকুঞ্জ আবাসিকের সেই জমির খাজনা দিতে গিয়ে দত্ত বাড়ির কয়া সুন্দরী দত্ত নাতনি  ও বিপিন দত্ত ও সুধামনি দত্তের পুত্রবতী কন্যা অংক প্রভার সন্তানেরা দেখতে পান তাদের জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে ২০২০ সালে ভুক্তভোগী ওয়ারিশ অংক প্রভা যুবদল নেতা শাহেদ আকবরকে বিক্রি শর্তে ও চুক্তি মুলে আইনিভাবে লড়তে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন। যুবদল নেতা শাহেদ আকবর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, আমাদের মধ্যে চুক্তি হয় যে, যখন আমি খতিয়ান করে আনবো, মামলা  আমাদের পক্ষে আসবে তখন জায়গাগুলো আমার কাছে বিক্রি করে দিবে। ২০২০ সালে সীতাকুণ্ড সহকারী জজ আদালতে মামলা করি। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলার পর বর্তমানে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।

সাইনবোর্ড-কাণ্ডের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি আকবর শাহ থানায় জিডি করেন যুবদল নেতা শাহেদ আকবর। এতে উল্লেখ করা হয়, মাহবুবুল আলম, সাইফুল ইসলাম, নাছির আহম্মদ ও রনি চক্রটি শাহেদ আকবরের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে আবার নিজেরাই খুলে নিয়ে যায়।

বিভিন্ন কুৎসা ও অপপ্রচার চালিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভুল তথ্য পাঠিয়ে তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ইমেজ নষ্ট করতে এমন প্রচেষ্টা বলে জিডিতে উল্লেখ করেন শাহেদ আকবর।

শাহেদ আকবর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে তার নাম ও দলীয় পদবি ব্যবহার করে সাইনবোর্ড দেন মাহবুবুল আলম, সাইফুল ইসলামরা। কিছু ছবি ও ভিডিও করে তারা আবার সাইনবোর্ড সরিয়ে নিয়ে যায়।

এর মধ্যে শাহেদ আকবরের বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজি অভিযোগও তোলা হয়। অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে মিডিয়া ট্রায়ালের কথা বলেন এই যুবদল নেতা। শাহেদ আকবর জানান, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা একটি নিউজে দেখা গেছে, একটা চেকে মুন্ডাতে লেখা আছে তপন দত্ত নামে একজন আমার পক্ষে ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। আরেকজনের নামে চেক দিলে তা তিনি কি করেছেন সেটা আমি কিভাবে জানবো? কোনো ধরনের ডিড ছাড়া ৫ লাখ টাকা কে কাকে দিবে? চাঁদাবাজির এই অভিযোগটি অপপ্রচার ও মিথ্যে বলে মন্তব্য করেন যুবদল নেতা শাহেদ আকবর।

যুবদল নেতা শাহেদ আকবরের পক্ষে যিনি ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই ইঞ্জিনিয়ার তপন দত্তের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাহবুবুল আলমের জায়গা নিয়ে শাহেদ আকবর একটি মামলা করেন। মামলাটা আপোষ করতে যে টাকা দেওয়ার কথা, সেটার কিস্তি হিসেবেই এই টাকা দেওয়া হয়।

টাকা কি ক্যাশে দেওয়া হয় নাকি চেকে, জানতে চাইলে প্রথমে কিছুটা এলোমেলো সুরে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পরে তপন দত্ত জানান, মাহবুবুল আলম থেকে নগদ ৫ লাখ টাকা নিয়ে ৪ লাখ টাকা শাহেদের কাছে দেন। বাকি এক লাখ নিজে পেতেন বলে রেখে দেন।

এসব বিষয়ে জানতে মাহবুবুল আলমের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি জানান, কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য টাকা দিতে হবে জানিয়ে শাহেদ আকবর তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেন।

জমির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ফটিকছড়ির এক মহিলা কয়েকটা গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অথচ তারা কখনো এই মহিলাকে দেখিনি। এখন শুনছেন শাহেদ আকবর এগুলোতে জড়িয়েছেন।

সাইনবোর্ড কাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম বলেন, আমার জমিতে ওনার নামে সাইনবোর্ড কেন দিবো আমি? মামলার বাদির অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেন মাহবুবুল।  তিনি বলেন, সেই মহিলা আদৌ মামলা করেছেন কিনা, সেটাই সন্দেহ আছে। তবে পরে আবার বলেন, সম্প্রতি আমরা মামলায় যুক্ত হয়েছি। এখন খারিজের দরখাস্ত দিয়ে মামলাটি খারিজ করবো।

এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগগুলোও অস্বীকার করেন মাহবুবুল আলম।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে যুবদল নেতা শাহেদ আকবর জানান, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নষ্ট করার জন্য অপরাধী চক্র এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কিছুদিনের মধ্যে মামলাটির রায় হবে, তাই তারা দিশেহারা হয়ে এমন তৎপরতা চালাচ্ছে।

তিনি জানান, টাকার বিনিময়ে মামলাটি আপোষ করতে প্রস্তাব দেয় মাহবুব, সাইফুলরা। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এখন অপপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক চরিত্র হননের চেষ্টা করছেন তারা।

তিনি আরও জানান, মাহবুব-নাছিররা আওয়ামী লীগের দোসর। সাইফুলতো অস্ত্র নিয়েই আন্দোলনের সময় মাঠে ছিল। এখনও তারা আওয়ামী লীগের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে। অথচ তাদের এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

শাহেদ আকবর প্রায় তিন দশকের রাজনৈতিক যাত্রায় ছাত্রদল ও যুবদলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক । ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সহসভাপতি হন তিনি। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেই কমিটি বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত এই পদেই দায়িত্ব পালন করেন এই যুবদল নেতা। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তৎপর ছিলেন তিনি। যার খেসারতও গুনতে হয় নানা হয়রানির মাধ্যমে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে যুবদল নেতা আসামি হয়েছেন অন্তত ২৫টি রাজনৈতিক মামলায়। করেছেন কারাবরণও।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm