চট্টগ্রামে ১৭ কোটির সড়ক এখন কাদার সাগর, সিটি কর্পোরেশন-বন্দর পাল্টাপাল্টি

কর্ণফুলীর কাদা তুলে সড়ক ডুবিয়েছে বন্দর

চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সড়ক কিছুদিনের ব্যবধানে কাদামাটি ও জলাবদ্ধতার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। কোতোয়ালী থানাধীন ফিরিঙ্গীবাজার এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ঘেঁষে নির্মিত এই মেরিনার্স সড়কটি বর্তমানে যানচলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এক হাজার ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার প্রস্থের এই সড়কটি নগরীর দক্ষিণাংশে সদরঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। অথচ সামান্য বৃষ্টি অথবা নদীর পাশ থেকে মাটি উত্তোলনের পরই সড়কজুড়ে কাদার স্তর জমে থাকে, সৃষ্টি হয় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা।

চসিক দোষ দিচ্ছে বন্দরকে, বন্দর বলছে এনডিই দায়ী

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই পরিস্থিতির জন্য সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে। তাদের দাবি, কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রমের কারণে সড়কের পাশে মাটির স্তূপ জমে ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে গেছে।

সিটি কর্পোরেশন জনসংযোগ বিভাগ জানায়, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ ও তাদের ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের কারণে এই জলাবদ্ধতা। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মাটি অপসারণ না হবে, ততক্ষণ কোনো ড্রেনেজ সমাধান কার্যকর হবে না।’

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দোষ চাপাচ্ছে প্রকল্পের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)-এর ওপর। তাদের মতে, নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণেই মেরিনার্স সড়কে এই দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

কর্ণফুলী থেকে উঠে আসছে হাজার হাজার ঘনমিটার কাদা

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পে ২০১৮ সালে ২৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৫ কোটি টাকায়। প্রতিদিন তিনটি ড্রেজারের মাধ্যমে গড়ে ছয় হাজার ৫০০ থেকে সাত হাজার ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে।

এই ড্রেজিংয়ের ফলে আটটি খালের মুখে জমে থাকা পলি ও বর্জ্য অপসারণ করা হলেও সঠিকভাবে সেই মাটি সরিয়ে না নেওয়ার ফলে মেরিনার্স সড়কে সরাসরি তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

নাগরিক ভোগান্তির চিত্র: কাদা, দুর্ঘটনা আর স্থবিরতা

নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। পায়ে হেঁটে চলাচল তো দূরের কথা, যানবাহন চালানোর অবস্থাও নেই এই সড়কে।

নিয়মিত যাত্রী ও বাসিন্দা ডা. শফিক আহমেদ তকি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ড্রেজিং হলেও কার্যত সেটি উল্টো মেরিনার্স সড়কে কাদা জমিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়িয়েছে।’

পথচারী মিজানুর রহমান জানান, ‘সড়কের মাঝখানে কালভার্টের পরে একটি ঢালু অংশ রয়েছে, যা সঠিকভাবে নির্মাণ না হওয়ায় প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। রাতে চলাচলের সময় মোটরসাইকেল চালকরা বিভ্রান্ত হয়ে যান।’

চাকরিজীবী শাহাদাৎ ও মোবারক বলেন, ‘পুরাতন ফিশারিঘাটের সামনে সড়কের উচ্চতা ভিন্নতার কারণে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো অংশ কাদা আর পিচ্ছিল হয়ে পড়ে।’

সিটি কর্পোরেশন বলছে, বন্দর ব্যবস্থা নেয় না

সিটি কর্পোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হামিদ জানান, ‘সড়কে কাদা জমার মূল কারণ নদী থেকে উত্তোলিত মাটি ও পানিমিশ্রিত কাদা। ড্রেনগুলো এসব মাটিতে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েছি, কিন্তু তারা ব্যবস্থা নেয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কালভার্টের পরে যে ঢালু অংশ রয়েছে, সেটি ঠিক করতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বন্দরের ড্রেজিং প্রতিষ্ঠানও দোষ দেয় এনডিই-কে

বন্দর কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রকৌশলী মো. শরীফ বলেন, ‘সড়কে কাদা আমাদের কারণে নয়, বরং এটি এনডিই নামক কোম্পানির কাজের ত্রুটির ফল। তারপরও আমরা সরেজমিনে পরিদর্শনে যাব। সমাধান করব।’

দুই দিক থেকেই কাদা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর

সিটি কর্পোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সুপারভাইজার মইনুল হোসাইন ওরমান বলেন, ‘একপাশে সেনাবাহিনী ও এনডিই মাটি আনছে, অন্যপাশে বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং করছে। ফলে দুই দিক থেকেই কাদা জমছে এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলছে। ড্রেনের স্ল্যাবও ভেঙে গেছে। আমাদের দল কিছুদিন আগে কাজ করলেও আবার কাদা জমে গেছে।’

আশ্বাস সিটি কর্পোরেশনের

সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা বলেন, ‘জনদুর্ভোগ লাঘবে মেরিনার্স সড়কের সমস্যাগুলো আমরা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করছি। শিগগিরই ড্রেনেজ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm