দোষীদের আড়াল করে চট্টগ্রামে রেল ডিপোর দুর্ঘটনার দায় অন্যের ঘাড়ে
তদন্ত প্রতিবেদন দেখে কর্মকর্তারাই অবাক
চট্টগ্রামে রেলের ডিপোতে মুখোমুখি সংঘর্ষে একটি ইঞ্জিনের চাকা লাইনচ্যূত হওয়ার ঘটনায় একের দায় চাপানো হল নিরীহ আরেকজনের ঘাড়ে। দায় চাপানোর এমন কথিত ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। তারা বলছেন, প্রকৃত দোষীদের দায়মুক্তি দিতে নিরীহ শিকার হিসেবেই তদন্তে কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই নিরীহ এক খালাসীর ওপর দায় চাপিয়ে দিয়েছে তদন্ত কমিটি।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের খুলশী থানাধীন রেলওয়ে নিউ স্টোর ডিপোতে দুটি ইঞ্জিনের মুখোমুখি সংঘর্ষে একটি ইঞ্জিনের ৪ চাকা লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় একজন খালাসীকে দায়ী করেই দায় সেরেছে তদন্ত কমিটি। যদিও এই দুই ইঞ্জিনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কোনো দায়দায়িত্বই নেই ফজলুল হক নামের ওই খালাসীর। তবু একজন পি-ম্যানের মৌখিক নির্দেশ না মানার দায়ে তদন্তে পুরো দায় চাপানো হয়েছে ফজলুল হকের ওপর। তবে ফজলুল হকের দপ্তরের যিনি ইনচার্জ, তার বক্তব্য এক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন। তিনি বলছেন খালাসীর দায়িত্ব গেইট বন্ধ করা ও খোলা। আর এই দুর্ঘটনার সাথে গেইট বন্ধ করা বা খোলার কোনো সম্পর্ক নেই।
এই দাবির সত্যতাও পাওয়া গেছে জেলা সরঞ্জাম দপ্তরের কর্মকর্তাদের কথায়ও। তারাও বলছেন, এই ঘটনায় কিভাবে একজন খালাসীকে দায় দেওয়া যেতে পারে, সেটিই বুঝতে পারছেন না তারা। পাশাপাশি প্রশ্ন তুলেছেন এই তদন্ত কমিটি গঠনে যথাযথ নিয়ম রক্ষা করা হয়েছে কিনা সেটি নিয়েও।
গত ২৩ ডিসেম্বর মালামাল পরিবহনকালে ২০১৯ নম্বর শাল্টিং ইঞ্জিন ও ২২০৪ নম্বর এরিয়া সাটল ইঞ্জিনের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ওইদিনই সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গত ২০ জানুয়ারি এই দুই ইঞ্জিনের দূর্ঘটনার জন্য খালাসী ফজলুল হককে ‘দায়ী’ করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিন্টেনডেন্ট বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২২০৪ নং এরিয়া ইন্জিন ওয়ার্কশপে প্রবেশের সময় গেইটে কর্মরত খালাসী জনাব ফজলুল হককে অন্য কোনো ইঞ্জিন ওয়ার্কসপের ভিতর প্রবেশ না করার জন্য বলা হয়। কিন্তু ওই সময় তিনি গেইটে উপস্থিত না থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ২৯১৯ নং ইঞ্জিন প্রবেশ করে এই কারনে উভয় ইঞ্জিনের সংঘর্ষ ঘটে এবং বিসি ১০০১১৯ এর চার চাকা লাইনচ্যূত হয়। এই দুর্ঘটনায় কর্তব্য কাজে অবহেলার জন্য জনাব ফজলুল হককে দায়ী করা হলো।’
পি-ম্যান রোকন উদ্দিন নিউ স্টোর ডিপোতে প্রবেশের সময় আরএনবির সদস্য ও খালাসী ফজলুল হককে এই নির্দেশ দেন বলেও একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যদিও প্রতিবেদনে আনা হয়নি খালাসীর সাথে থাকা রেলওয়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) সদস্যের নাম। একই নির্দেশ পাওয়া সেই আরএনবি কর্মকর্তাকে দায়ও দেওয়া হয়নি এজন্য।
জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় ২২০৪ ইঞ্জিনে ছিলেন এলএম শফিকুল আলম ও এএলএম সোহরাব হোসেন। অন্যদিকে ২৯১৯ ইঞ্জিনে ছিলেন এএলএম মনিরুল ইসলাম। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ২২০৪ ইঞ্জিনে এলএম শফিকুল আলমের থাকার কথা থাকলেও তার পরিবর্তে ইঞ্জিনে ছিলেন সোহরাব হোসেন। কিন্তু তদন্তে এসব বিষয় আড়াল করা হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সহকারী জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) বেদার উদ্দিন এই তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে কিভাবে ফজলুক হককে দায়ী করা হয়েছে সেটি বুঝতে পারেননি জানিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘লোহার গেইট খোলা-বন্ধ করা খালাসী কিভাবে এ ঘটনায় দায়ী হয় তা আমার বোধগম্য নয়।’
‘কর্তব্য কাজে’ অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত ফজলুল হকের দাবি যে কাজের জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে সেটা তার কাজের মধ্যেই পড়ে না। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব গেইটের তালা খোলা ও বন্ধ করা। ইঞ্জিন কখন কিভাবে চলবে সেটা সিগন্যাল বা পরিবহন দপ্তরের কাজ। আমার দায়িত্বশীল বস কোনো কর্তব্য অবহেলা পেয়েছে কিনা উনাদেরই জিজ্ঞাসা করুন।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে খালাসীদের ইনচার্জ উপ সহকারী প্রকৌশলী গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘খালাসীর কাজ গেইট খোলা আর বন্ধ করা। আমি সেই নির্দেশ দিয়েছি। অন্য কোনো নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। আমি সেটা দিইওনি।’
জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (নিউ স্টোর ডিপো) সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘সত্যি বলতে তদন্ত প্রতিবেদনে
আমিও বিস্মিত। কোনভাবেই খালাসী ফজলুল হকের দোষ খুঁজে পাচ্ছি না যে তাকে শাস্তি দেবো।’
পাশাপাশি এই তদন্ত কমিটিতে নিয়ম অনুযায়ী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কাউকে না রাখায় উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটিতে আমার দপ্তরের কোনো স্টাফকে না রাখাটা দুঃখজনক।’
উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সাজ্জাদুল ইসলাম।
এদিকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সরেজমিনে গিয়ে সাক্ষীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে ‘যা পেয়েছেন’, তার ওপর এই প্রতিবেদন দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
এই বিষয়ে কথা বলতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিআরএম) তারেক মোহাম্মদ সামছ তুষারের মুঠোফোনে দফায় দফায় ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এআরটি/সিপি