বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) নির্বাচন ঘিরে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২৫ অক্টোবর নির্ধারিত নির্বাচনের আগে তিন সদস্যের কমিশনের দুজনই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বাকি একজন কমিশনারও পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশনের এই নির্বাচনে মোট ১১টি পদের জন্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। সবগুলো পদের ক্ষেত্রেই বিস্ময়করভাবে একক প্রার্থী থাকায় বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। নির্ধারিত সিডিউল অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার কথা ছিল।
কিন্তু প্রার্থীদের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন ও মন্ত্রণালয় নির্ধারিত কাগজপত্র সময়মতো জমা না পড়ায় নির্বাচন প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তায় পড়ে। ১৩ অক্টোবর ছিল প্রার্থীদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিন। সেই সময়ের মধ্যে অনেক প্রার্থী প্রয়োজনীয় নথি জমা দেননি। যারা জমা দিয়েছেন, তাদের কাগজপত্রও এখনো মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই হয়ে ফেরত আসেনি।
এই অবস্থায় কমিশনের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। তার আগের দিন সোমবার (১৩ অক্টোবর) কমিশনের আরেক সদস্য জহিরুল ইসলাম চৌধুরীও পদত্যাগ করেন। কমিশনে এখন একমাত্র সদস্য খায়রুল আলম সুজন রয়েছেন। তিনি বুধবার (১৫ অক্টোবর) দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
পদে পদে নীতিমালা ভঙ্গ
জানা গেছে, প্রার্থিতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয় থেকে প্রার্থীদের সিবিআই (ব্যাংক) প্রতিবেদন, হালনাগাদ আয়কর রিটার্ন ও ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কিনা— এসব তথ্য সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচন কমিশনও সেই অনুযায়ী প্রার্থীদের নির্দেশনা দেয়। কিন্তু প্রার্থীরা তা মানেননি।
জানা গেছে, এই প্রথম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ডিরেক্টরেট অফ ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডিটিও), যারা বিভিন্ন ট্রেড অর্গানাইজেশনের কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে, একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। নির্বাচনের প্রার্থীরা তো বটেই, ভোটার হওয়ার যোগ্যতা নিয়েও একটি গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়।
প্রার্থীদের ক্ষেত্রে হালনাগাদ আয়কর ও ভ্যাট সনদ, পুলিশ ভেরিফিকেশন সনদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) রিপোর্ট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। এ অনুযায়ী নির্বাচনী বোর্ড থেকে সব প্রার্থীর কাছেই এসব তথ্য ও কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু জানা গেছে, বেশিরভাগ প্রার্থীই এসব তথ্য জমা দেননি। কেউ কেউ দিলেও সেসব কাগজপত্রের সত্যতা নিয়েও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। পরে জমা পড়া কাগজপত্র চেক করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিওতে পাঠানো হলেও মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত সেখান থেকে কোনো জবাব আসেনি।
কী আছে পদত্যাগপত্রে
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইকেল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বরাবরে দেওয়া পদত্যাগপত্রে বিএসবিআরএ নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু লিখেছেন—‘গত ১২ জুলাই বিএসবিআরএ’র ১২তম কার্যনির্বাহী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমাকে বিএসবিআরএ নির্বাচন-২০২৫ এর নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। বিএসবিআরএ নির্বাচন ২০২৫ প্রক্রিয়াধীন আছে। কিন্তু সিডিউল মোতাবেক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম সম্পাদনে বেশ কয়েকটি দফায় নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী কিছু প্রার্থীর নির্বাচনী আচরণ-বিধি লঙ্ঘন, শর্ত মোতাবেক সময়মত ডকুমেন্টস জমা না দেওয়া এবং আইন ও বিধি মোতাবেক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে প্রার্থীদের উদাসীনতা ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রেস কনফারেন্সসহ নানামুখী বক্তব্য ও বিবৃতি প্রদান হতে বিরত থাকার জন্য বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কিছু কিছু প্রার্থী সেসব উপেক্ষা করাসহ নানাবিধ কারণ ও অনিয়ম দৃষ্টিগোচর হওয়ায় এবং পরবর্তীতে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনার কোন উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব হতে আমি অব্যাহতি নিলাম এবং সে মোতাবেক পদত্যাগপত্র আপনার বরাবর পেশ করলাম।’
কথায় অসন্তোষ
পদত্যাগের বিষয়ে কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন, নির্ধারিত কাগজপত্র জমা না দেওয়া এবং আইনি শর্ত মানতে অনীহাসহ নানা কারণে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি।’
বর্তমানে নির্বাচন বোর্ডে থাকা একমাত্র সদস্য খায়রুল আলম সুজন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তিন সদস্যের মধ্যে এখন দুজন রিজাইন দিয়েছেন। এখন আমার থাকা না থাকা একই সমান হয়ে গেছে। চাইলেও কোনো কাজ এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
হঠাৎ করে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে ১১টি পদে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সকলেই নির্বাচিত হয়েছেন বলে হঠাৎ করে দাবি করা হয়। এতে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বলে দাবি করেন আমজাদ হোসাইন চৌধুরী। তিনিই শুধু নন, বলা হয় বাকি ১১টি পদেও সবাই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন। এরা হলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মহসিন চৌধুরী (পিএইচপি), ভাইস প্রেসিডেন্ট নাওশীর হাসান (ক্রিস্টাল শিপার্স) ও গাজী মোকারম আলী চৌধুরী (চিটাগাং শিপব্রেকিং)।
এছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত নির্বাহী সদস্য হিসেবে দাবি করে নাম উল্লেখ করা হয় যাদের, তারা হলেন হোসাইনুর আরেফীন (জনতা স্টিল), এস এম নুরুন নবী (বিওবি), নুর উদ্দিন রুবেল (ফোর স্টার স্টিল এন্টারপ্রাইজ), মো. তসলিম উদ্দিন (কেআর গ্রিন শিপ রিসাইক্লিং), ফেরদৌস ওয়াহিদ (ফেরদৌস স্টিল), মো. সেলিম উদ্দিন (খাজা আজমীর) এবং ইয়ামিন ওবাইদা আসাদী (প্রগ্রেসিভ শিপ রিসাইক্লিং)।
তবে নির্বাচন বোর্ড এই কমিটিকে এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। সভাপতি হিসেবে দাবি করা আমজাদ হোসাইন চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. আসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই।
সিপি