শিবির নেতাকে ঘিরে পোস্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল ছাত্রকে কলেজছাড়া করলো ‘রাতের মব’
জুলাই আন্দোলনের কর্মীকে ‘ছাত্রলীগের’ ট্যাগ
ছাত্রশিবির নেতা সাদিক কায়েমকে ইঙ্গিত করে একটি মৃদু সমালোচনামূলক ফেসবুক পোস্টের জেরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে একাধিকবার ‘মব’ তৈরি করে হেনস্তার পর ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে ‘ছাত্রলীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে কলেজ প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে একাডেমিক কার্যক্রম থেকেও বিরত রাখা হয়েছে। পুরো ঘটনার পেছনে কলেজ প্রশাসনকে ‘বাধ্য করা’র অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য আসিফ হাসান নিয়ন, যিনি এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
জরুরি সভায় তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় তড়িঘড়ি করে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি গঠিত হয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও, ঘটনাটি সামনে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর নেতারা অবিলম্বে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
ফেসবুক পোস্ট ঘিরে উত্তেজনা
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম ‘ছাত্রলীগ পুনর্বাসন’ নিয়ে ছাত্রদলকে উদ্দেশ্য করে একটি বিদ্রুপাত্মক পোস্ট দিলে সেখানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাজমুল নামের এক শিক্ষার্থী সাদিক কায়েমের আগের ছাত্রলীগ পরিচয় নিয়ে একটি মন্তব্য করেন। এরপরই মুরাদ নামের এক শিবিরকর্মী ছাত্রাবাসে নাজমুলের কক্ষে গিয়ে তাকে শাসিয়ে আসে। এর প্রতিবাদে এরপর আসিফ হাসান নিয়ন ফেসবুকে লিখেন—‘সাদিক কায়েম না খেলে আমরা কেন এক বছর পর ছাত্রলীগ বলে ট্যাগ খাবো?’
রাতের ছাত্রাবাসে আচমকা ‘মব’
সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত এর পর থেকে নিয়নকে ‘সাইজ’ করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। গত সোমবার (৭ জুলাই) রাতে একদল নেতাকর্মী প্রথমে মেডিকেল গোয়াছিবাগান এলাকার প্রধান ছাত্রাবাসে আসিফ হাসান নিয়নের কক্ষে যান। তারা জোর করে দরজা খুলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়নকে হলের ডাইনিং রুমে নিয়ে যান। সেখানে ‘ছাত্রলীগ’ আখ্যা দিয়ে তাকে গালিগালাজ করা হয়। কেউ কেউ তাকে চড়-থাপ্পড়ও মারেন। একই সময়ে নিয়নের ওই বন্ধুকেও একইভাবে শিবিরের অপর একদল কর্মী গিয়ে ডাইনিংয়ে নিয়ে আসেন। তাকেও গালিগালাজ করা হয়। সিনিয়র ব্যাচকে ‘মক’ করার অভিযোগ তুলে তারা ‘মানহানি’র প্রসঙ্গও তোলে। পরে খবর পেয়ে কলেজ অধ্যক্ষ ডা. অধ্যাপক জসিম উদ্দিনসহ শিক্ষক ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এক বছর পর হঠাৎ ‘ছাত্রলীগের ট্যাগ’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আসিফ হাসান নিয়ন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে রীতিমতো মব তৈরি করে হেনস্তা করা হয় প্রথমে। এরপর কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায়ও তারা মব তৈরি করে আমাকে বহিস্কারের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। অভিযোগ—সিনিয়র ব্যাচকে অসম্মান এবং ‘ছাত্রলীগের দোসর’ পরিচয়। অথচ তাদের কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছুই বলিনি আমি। তাছাড়া একটি ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে কিভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব? দ্বিতীয়ত তারা আমাকে ছাত্রলীগের দোসর বলে অভিযোগ দিয়েছে। অথচ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই পাবলিক পোস্ট দিয়ে আমি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছি। এর এক বছর হঠাৎ করে কেন আমার ওপর ‘ছাত্রলীগের ট্যাগ’ আসবে? কেন আমি ছাত্রলীগ বলে ট্যাগ খাবো?’
হোস্টেল সুপারের দাবি ও পাল্টা বক্তব্য
হোস্টেল সুপার অধ্যাপক হাবিব হাসান দাবি করেছেন, নিয়ন ব্যাচভিত্তিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছাত্রদল, শিবির ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের গালিগালাজ করতেন। পোস্টটি ফেসবুকেও দেন। এর পর উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা তাকে হল ছাড়ার আল্টিমেটাম দেয়।
তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এক ফেসবুক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রকে ‘ছাত্রলীগ ট্যাগ’ দিয়ে বহিষ্কার করা অসাংবিধানিক ও দমনমূলক।
‘অযৌক্তিক দমনমূলক পদক্ষেপ’
ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ হাসান নিয়ন অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে গণতান্ত্রিক চেতনায় সোচ্চার হন এবং জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অথচ তার বিরুদ্ধেই অযৌক্তিকভাবে দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
তারা বলেন, ‘সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাদিক কায়েম সংক্রান্ত এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে নিয়নকে শিবিরের হুমকির মুখে পড়তে হয়। এর পরপরই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রটির বিরুদ্ধে হল থেকে বহিষ্কার ও একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে, যা একেবারেই অযৌক্তিক, অগণতান্ত্রিক এবং মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক আরিফ মঈনুদ্দিন বলেন, ‘আসিফ হাসান নিয়নের এক বন্ধুই কোথাও সাদিক কাইয়ুমের সমালোচনা করে কমেন্ট করেছিল, এরপর শিবিরের ছেলেরা এসে ওই বন্ধুকে গালিগালাজ করে যায় রাতে। তখন সাইফ হোসেন নিয়নও প্রতিবাদমূলক একটি পোস্ট দেন। শুধুমাত্র এই কারণে তাকে ছাত্রলীগের ট্যাগ দিয়ে বহিস্কার করা হয়েছে হল থেকে।’
প্রশাসনের বক্তব্য
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিবৃতি প্রসঙ্গে হোস্টেল সুপার অধ্যাপক হাবিব হাসান রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এরকম কোনো বিবৃতি পাইনি। আর বহিষ্কারের ঘটনা তো আমাদের একক ইচ্ছায় হয়নি। একাডেমিক কাউন্সিলিংয়ের মিটিংয়ে সব প্রফেসর মিলে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাই এ নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি না।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে যাচাই করে বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সিপি