শিল্পপতির মেয়ে সেজে নেতা পটানো ছাত্রলীগ নেতা এবার ধরা ‘ডেভিল হান্টে’

সুন্দরী এই ‘তরুণী’র সঙ্গে চট্টগ্রামের একাধিক নেতার ছিল রীতিমতো প্রেমের সম্পর্ক। রাতভর মেসেঞ্জারে মেতে থাকতেন প্রেমের আলাপে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাই শুধু নয়, প্রভাবশালী বাঘা নেতাও ছিলেন এই তালিকায়। প্রেমের সেই জালে ধরা পড়েছেন নিষিদ্ধঘোষিত নগর ছাত্রলীগের নেতাও। এমনকি প্রশাসনেরও কারও কারও সঙ্গে মধুর আলাপনে ভরা ছিল তার ফেসবুক মেসেঞ্জারের ইনবক্স। সেই চ্যাটই একসময় হয়ে ওঠে ‘তরুণী’র মূল পুঁজি। প্রথমে দাবি করেন টাকা, টাকা না দিলে দেখান চ্যাটের স্ক্রিনশট ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি।

পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে, বাঘা বাঘা নেতা ছাড়াও প্রশাসনের বড় কর্তাকে ঘোল খাওয়ানো এই তরুণী আসলে ২৬ বছরের এক যুবক। নাম তার জুবাইরুল হক জিয়ান। পুলিশই জানায়, তরুণী সেজে ওই যুবক এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুবাইরুল হক জিয়ান নামের এই যুবক বছরদুয়েক ছিলেন বিদেশে। বছরপাঁচেক আগে দেশে ফিরে এসে সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন। জিয়ান ২০২০-২০২২ সালে সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সাতকানিয়ার ছদাহা ইউনিয়নের ছৈয়দাবাদ ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আব্দুল আজিজ ওরফে আবদুল্লাহর ছেলে।

জেল থেকে বেরিয়ে ফের প্রতারণায়

এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রভাবশালীদের ব্ল্যাকমেইল আর প্রতারণার দায়ে জুবাইরুল হক জিয়ান কয়েকবছর আগে জেলও খেটেছেন। জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি ফের আবার প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি মামলা নিয়ে বাণিজ্য শুরু করেন৷ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তীতে জামিন আর মামলা থেকে অব্যাহতির নামে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকায় দেশীয় অস্ত্র হাতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতকানিয়া থানার পুলিশের সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকায় এসব ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের হলেও তার একটিতেও নাম নেই জিয়ানের। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরও উল্টো পুলিশের যোগসাজশে এলাকার নিরীহ লোকদের মামলা ও গ্রেপ্তার করিয়ে দিচ্ছেন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা জিয়ান।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জিয়ান ছদাহা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. হাসান ও মো. আরিফ, ছদাহা ছমদিয়া পুকুর পাড়ের ডা. শাব্বির, ছৈয়দাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক জাকরিয়াকে (বিএড) মিথ্যা মামলায় ঢুকিয়ে হয়রানি করছিলেন।

শেষমেশ শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে জুবাইরুল হক জিয়ানকে গ্রেপ্তার করেছে সাতকানিয়া থানার পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’র আওতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জুবাইরুল হক জিয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়। শনিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে গত বছরের ১৮ জুলাইয়ের একটি ঘটনায় জনৈক তসলিমের দায়ের করা একটি মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে।

জিয়ানের প্রেমের জালে বাঘা বাঘা লোক যেভাবে ধরা

চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাতের মালিকের মেয়ের ছবি ও অন্যান্য তথ্য ব্যবহার করে ফেসবুকে খোলেন ভুয়া আইডি। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার সুবাদে নেতাদের ‘চাহিদা’ সম্পর্কে জেনে ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে টোপ ফেলতে থাকেন। এমন টোপে বাঘা বাঘা নেতারাও সহজেই ধরা দেন। জিয়ান হয়ে যান ফেসবুকের ওই প্রান্তে থাকা নেতাদের স্বপ্নের রমণী!

জানা গেছে, জুবাইরুল হক জিয়ান দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জিপিএইচ ইস্পাতের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ের ছবি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরের দুই প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা, সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতা, মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা এবং সাতকানিয়া উপজেলা যুবলীগের এক নেতার সাথে জিপিএইচ মালিকের মেয়ে সেজে প্রেমালাপ করে আসছিলেন। প্রেমালাপের ভেতরেই নানা অজুহাতে তিনি টাকা চাইতেন। টাকা না দিলে ওই চ্যাটের স্ক্রিনশট ফাঁস করার ভয় দেখাতেন। এতে এদের অনেকেই তাকে টাকা দিতে বাধ্য হতেন। এভাবে কয়েক লাখ টাকা ওই যুবক আদায় করেছে বলে ওই সময় তথ্য পায় পুলিশ।

কয়েকজন নেতার প্রেমালাপ ও প্রতারণার কথা ছড়িয়ে পড়লে ২০০০ সালের ২৭ মে জিপিএইচ ইস্পাতের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ের স্বামী চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, দুটি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে তার স্ত্রীর নাম দিয়ে আপত্তিকর ছবি আদান-প্রদান ও অশালীন কথোপকথন আদান-প্রদানের মাধ্যমে তার পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও আত্মীয়স্বজনের কাছে থেকে টাকা দাবি করা হচ্ছিল।

এই অভিযোগের সূত্র ধরে পুলিশ মাঠে নামে নেপথ্যে থাকা মূল অপরাধীর খোঁজে। কিন্তু ধূর্ত এই যুবকের হদিসও পাচ্ছিল না পুলিশ। এর মধ্যেই একটি ভুলে ধরা পড়ে যায় জিহান নামের ওই যুবক। ২০০০ সালে ঈদ উল ফিতরের সময় সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার কেন্দ্রীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছার ভিডিও কলে জিপিএইচ মালিকের মেয়ের ছবি বসিয়ে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে ওই যুবক। এতে প্রতারক ওই যুবক সম্পর্কে প্রথম ধারণা পায় পুলিশ। তদন্তে নেমে দেখা যায়, ‘জিপিএইচ মালিকের মেয়ের প্রেমে’ মগ্ন হয়ে কোনো নেতা কথা বলতে চাইলে অভিযুক্ত জিয়ান তার এক তরুণী আত্মীয়কে ব্যবহার করতেন।

মেসেঞ্জারে প্রেমালাপের ভাণ্ডার

২০০০ সালের ২৯ মে রাতে সাতকানিয়া সার্কেলের এএসপি হাসানুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে সাতকানিয়া থানা পুলিশ এই ফেসবুক প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। জিয়ানের কাছ থেকে ওই সময় তিনটি মোবাইল ফোন ও পাঁচটি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জিহানকে গ্রেপ্তার করার পর দেখা গেছে, তার প্রেমের ফাঁদে পড়েছেন আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী তরুণ নেতা ছাড়াও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা, সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতা, সতিপাড়ার বাসিন্দা এক যুবলীগ নেতা ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সম্পাদকীয় পদধারী এক নেতাও। এরা সকলেই ‘জিপিএইচ মালিকের মেয়ে’ সেজে প্রতারণা করা ওই যুবকের সঙ্গে মেসেঞ্জারের ইনবক্সে অনেক প্রেমপূর্ণ ঘনিষ্ঠ আলাপ করেছেন বলে জানা যায়। ২০০০ সালের এপ্রিলে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা এজাহারে যে দুটি মোবাইল নম্বরের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, নেতাদের অনেকে সেই নম্বরগুলোতে বিকাশে টাকাও দিয়েছেন।

গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জিয়ান সাতকানিয়া পুলিশের তৎকালীন সার্কেল হাসানুজ্জামান মোল্লার শ্যালিকাকে ব্ল্যাকমেইলিং করে চাঁদা আদায়, সাতকানিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মো. সেলিমকে ব্ল্যাকমেইল করে নিয়মিত বিকাশে টাকা আদায়, সাতকানিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এনামুল হকের কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল আদায় করার কথা স্বীকার করেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm