চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর অভয়মিত্রঘাটের পর এবার সদরঘাটের ইজারা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে পেশাদার সাম্পান মাঝিদের (পাটনিজীবী) টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। বৈঠা যার, ঘাট তার—এই নীতি হলেও সাম্পান মাঝিদের জন্য বাস্তবতা ভিন্ন। অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকৃত পাটনিজীবীদের কাছ থেকে ঘাটগুলো কেড়ে নিয়ে একটি চক্রের হাতে তুলে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এই চক্রটি বহিরাগত ও নামসর্বস্ব পাটনিজীবীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে চসিক মেয়রকে বিভ্রান্ত করে একের পর এক ঘাটের নিয়ন্ত্রণ দিচ্ছে।
যারা নতুন করে সদরঘাটের খাস কালেকশনের দায়িত্ব পাচ্ছেন, তাদের কেউই পেশাদার মাঝি নন। তারা নিজেদের মেয়রের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এতে করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাট—সদরঘাট, অভয়মিত্রঘাট ও বাংলাবাজারের প্রায় ১ হাজার মাঝির জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
সাম্পান মাঝিদের অভিযোগ, তারা আগেভাগেই সিটি মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এস্টেট শাখার কাছে দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু চসিকের কিছু কর্মকর্তা সেই আবেদন মেয়রের সামনে তুলে ধরেননি। ফলে মেয়র প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরে রয়েছেন। এতে রাজস্ব শাখার কিছু ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছেন, যা প্রকৃত মাঝিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, কর্ণফুলীর ঘাট ইজারার অনিয়মের পেছনে সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি জড়িত। এ কারণেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিছু ব্যক্তি ঘাট দখলের সুযোগ পাচ্ছেন, যা সাধারণ মাঝিদের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে সাম্পান মাঝিরা দীর্ঘদিন ধরে ঘাটগুলোতে যাত্রী পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তারা বহুবার সিটি কর্পোরেশনের কাছে প্রকৃত পাটনিজীবীদের তালিকা পুনর্গঠনের অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। বরং বহিরাগতরা ভুয়া পরিচয়ে পাটনিজীবী তালিকাভুক্ত হয়ে ঘাটের ইজারা/খাস কালেকশন আদায়ের কাজ নিচ্ছে। এতে করে প্রকৃত মাঝিরা কাজ হারাচ্ছেন এবং সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
গত ২৩ মার্চ মো. হাসান রুবেল নামে এক ব্যক্তিকে সদরঘাটের খাস কালেকশনের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কখনো সাম্পান চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবুও সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী তাকে এই দায়িত্ব দেন।
এর ফলে প্রায় তিন ঘাটের ১ হাজার পেশাদার সাম্পান মাঝির জীবিকা সংকটে পড়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মাঝিরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
২৫ মার্চ কর্ণফুলীর ১ হাজার সাম্পান মাঝি ও তাদের পরিবারের ১৫ হাজার মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ইছানগর সদরঘাট সাম্পান টেম্পু মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শফি সিটি কর্পোরেশনের কাছে লিখিত দরখাস্ত জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সদরঘাটের পাটনিজীবী মাঝিরা দীর্ঘদিন ধরে খাস কালেকশনে সিটি কর্পোরেশনকে সহযোগিতা করে আসছে। এখন বহিরাগত কাউকে দায়িত্ব দিলে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ, উপজেলা বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক মো. ইসমাইল, চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মির্জা মোহাম্মদ ইসমাইল, সাধারণ সম্পাদক সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এম মঈন উদ্দিন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এসএম পেয়ার আলী, সিনিয়র সহ-সভাপতি জাফর আহমেদ, চরপাথরঘাটা ব্রিজঘাট সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কোরবান আলী, চট্টগ্রাম ইছানগর বাংলাবাজার ঘাট সাম্পান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ, সদরঘাট সাম্পান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ, ইছানগর সদরঘাট সাম্পান মালিক সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক আবদুন নবী, সিনিয়র সদস্য মো. শাহাজান, জানে আলমসহ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত সকল ঘাটের সদস্যবৃন্দ।
এর আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রিট পিটিশন (১৫১৬৩/২৩) অনুযায়ী অভয়মিত্র ঘাটের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু ২৩ অক্টোবর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ফেরিঘাট ইজারার ১০ নম্বর শর্ত প্রত্যাহার করে দেন। এতে অনেকে অভিযোগ করছেন, আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে সিটি কর্পোরেশন কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে।
আইনি নীতিমালা অনুসারে, স্থানীয় সরকার নীতিমালার ফেরিঘাট ব্যবস্থাপনা নীতিতে (অনুচ্ছেদ ২) পেশাদার পাটনিজীবীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০-এর ২৪০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পেশাদার মাঝিরাই ঘাট ইজারার বৈধ দাবিদার।
তবে সদরঘাটে সদ্য খাস কালেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি সংসদ (চট্টগ্রাম মহানগর)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাসান তারেক বলেন, ‘আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট শাখা থেকে সদরঘাটের খাস কালেকশনের দায়িত্ব পেয়েছি। এর আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন—এর প্রমাণও রয়েছে। তবে আমি কখনো সাম্পান মাঝিদের পেটে লাথি মারব না বরং তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করব। সাধারণ যাত্রীরা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হবেন না, আর ঘাটে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড চলতে দেওয়া হবে না। এটা আমার নেতার নির্দেশ।
তিনি আরও বলেন, সদরঘাটের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যেমন যাত্রী ছাউনি ও পল্টনের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে মাঝিদের সঙ্গে আবারও বসব। আমি ইতোমধ্যে ব্রিজঘাটের সাম্পান মাঝিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং তাদের সমস্যাগুলো সরাসরি শুনেছি।
মাঝিদের দাবির পক্ষে কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এসএম পেয়ার আলী বলেন, ২০০৩ সালের পাটনিজীবী নীতিমালা লঙ্ঘন করে বহিরাগতদের দিয়ে ঘাটের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি সাম্পান মাঝিদের জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত। সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই মাঝিদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। না হয় আন্দোলন ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
সদরঘাট রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক চৌধুরী ফরিদ বলেন, সদরঘাট কর্ণফুলীর একটি ঐতিহ্যবাহী নৌঘাট। এটি মাঝিদের সংগ্রামের ফসল। এখানে যদি অনিয়ম হয়, তাহলে মাঝিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। সিটি কর্পোরেশনের উচিত নীতিমালার ভিত্তিতে প্রকৃত মাঝিদের হাতে ঘাটের দায়িত্ব দেওয়া।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল জানান, মাঝিদের অভিযোগ আমরা আমলে নিয়েছি। মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করব। সিটি কর্পোরেশন সব সময় নীতিমালা মেনে কাজ করে, মাঝিদের ক্ষতি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
জেজে/ডিজে