চট্টগ্রামজুড়ে অস্ত্র বেচাকেনার নেটওয়ার্কে পুলিশেরও ছায়া, বড় বাজার সাতকানিয়া
চার হাত বদলে পতেঙ্গায় যায় লোহাগাড়ার পিস্তল
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামায়াতে ইসলামী নেতা নেজাম উদ্দিন ক্ষুব্ধ জনতার পিটুনিতে নিহত হওয়ার পর তার মরদেহের পাশে থানা লুটের একটি অস্ত্র পাওয়া যায়। নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত নেজাম ওই পিস্তল থেকে একের পর এক গুলি ছুঁড়ে গেছেন। অত্যাধুনিক পিস্তলটির ম্যাগাজিনে একসঙ্গে ১৭ রাউন্ড গুলি রাখার ব্যবস্থা থাকলেও নেজামের মরদেহের আশপাশ থেকে ছয় রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যেই অস্ত্র বেচাকেনায় সম্প্রতি সাতকানিয়ার বাসিন্দা এক পুলিশ কনস্টেবলের নাম ওঠে আসে। তার কয়েকটি কলরেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর বিশদ অনুসন্ধানে নেমে পুলিশ পায় অস্ত্র বেচাকেনার বড় এক নেটওয়ার্কের খোঁজ। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও বিষয়গুলো জানেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের গোপন পৃষ্ঠপোষকতাও।

ঝড়ো অভিযান সাতকানিয়া থেকে পতেঙ্গায়
বুধবার (১৯ মার্চ) দিবাগত মধ্যরাত থেকে একটানা অভিযানে সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা থেকে অস্ত্রব্যবসায়ী ও স্থানীয় সন্ত্রাসী ফরহাদ হোসেন ও ইসহাককে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একটি দল। পরদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার কাটগড় এলাকার নিজ বাসা থেকে থানা লুটের ‘টরাস’ পিস্তল ও সাতটি গুলিসহ আবদুল গণিকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানার পুলিশ। পরে বাকলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্রব্যবসায়ী আবু বক্কর ও মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে গুরুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ফরহাদ ও গণি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাকিরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই রাতেই আগে থেকে পুলিশের হেফাজতে থাকা কনস্টেবল রিয়াদকেও পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায়। এর পরপরই তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাতে পতেঙ্গার কাটগড় থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আফতাব হোসেন বাদি হয়ে পতেঙ্গা থানায় মামলা করেন।
শুক্রবার (২১ মার্চ) বিকেলে গ্রেপ্তার ছয়জনকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালতে নেওয়ার পর অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল রিয়াদ, আবু বক্কর ও মোস্তাফিজুর রহমান। ইসহাক জবানবন্দি দেননি। অন্যদিকে আবদুল গণি ও ফরহাদ হোসেনকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গণির হাতে কিভাবে গেল লোহাগাড়ার পিস্তল?
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, নেজামের সহযোগী ফরহাদকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে জানা যায় থানা থেকে লুট হওয়া অন্তত একটি ‘টরাস’ পিস্তল আছে সাতকানিয়ার কাঞ্চনা এলাকার বাসিন্দা অস্ত্রব্যবসায়ী বক্করের হাতে। তখনও পুলিশের ধারণা ছিল, সেটি কোতোয়ালী থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তলগুলোর একটি। এই সূত্র ধরে বক্করকে ধরার পর পুলিশ জানতে পারে, দাম বেশি হওয়ায় নেজাম সেই পিস্তলটি কেনেননি। বক্কর আগে কাঞ্চনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আ ম ম মিনহাজের অনুসারী। ৫ আগস্টের পর তিনি সাতকানিয়া ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরের কাটগড় এলাকায় জামায়াত নেতা ব্যবসায়ী আবদুল গণির বাসায় সপরিবারে আশ্রয় নেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কাঞ্চনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রমজান আলীর ছেলে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা ইরফানও এই আবদুল গণির আশ্রয়ে তার কাটগড়ের বাসায় ছিলেন বলে জানা গেছে। গণির বাড়িও সাতকানিয়ার কাঞ্চনার হাজারীখিলে। তবে তিনি চট্টগ্রাম নগরীর কাটগড় এলাকায় বসবাস করেন। তার মালিকানায় আছে দুটি ডায়াগনস্টিক ল্যাব। গণি সম্পর্কে বক্করের স্ত্রীর খালাতো বোনের স্বামী। কাটগড়ের বাসায় অবস্থানকালেই বক্কর ‘টরাস’ পিস্তলটি পাঁচ লাখ টাকায় গণির কাছে বিক্রি করে দেন। অস্ত্রব্যবসায়ী বক্কর কয়েক মাস আগে জন্ম নেওয়া তার সন্তানের নামও রেখেছেন ‘টরাস’।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) মধ্যরাতে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার কাটগড় এলাকার নিজ বাসা থেকে আবদুল গণিকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানার পুলিশ। ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় থানা লুটের সেই ‘টরাস’ পিস্তল, যার বডি নাম্বার TKT22605। পরে যাচাইবাছাইয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উদ্ধার করা অস্ত্রটি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার। গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় একদল দুর্বৃত্ত লোহাগাড়া থানায় আগুন দিয়ে ভাঙচুর চালায়। এ সময় দুর্বৃত্তরা বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বক্কর স্বীকার করেছেন, লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার এক লোকের কাছ থেকে তিনি ‘টরাস’ পিস্তলটি সংগ্রহ করেন। এই বেচাকেনায় মধ্যস্থতা করেছেন আরও দুজন। এই বাবদে তারা ১০ হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন।
পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, চুনতির সেই লোক মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ী। লোহাগাড়া থানা লুটে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন— এমনও ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ এখন তাকে খুঁজছে হন্যে হয়ে।
ফরহাদ: গণপিটুনিতে নিহত নেজামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) ভোর চারটার দিকে সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা থেকে ৪০ বছর বয়সী ফরহাদকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একটি দল। মধ্যম কাঞ্চনা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তারের ছেলে ফরহাদ গত ৫ মার্চ সাতকানিয়া থানায় অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া মামলার দ্বিতীয় আসামি। জামায়াতের স্থানীয় এই নেতা গণপিটুনিতে নিহত আরেক জামায়াত নেতা নেজামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে এলাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগেও স্থানীয় জামায়াত কর্মী মহিউদ্দিন ও ডিশ ব্যবসায়ী সোহাগকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ফরহাদের বিরুদ্ধে চারটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো হচ্ছে— ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর সাতকানিয়া থানার এফআইআর নং-৯, ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়া থানার এফআইআর নং-১, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়া থানার এফআইআর নং ২২, ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর সাতকানিয়া থানার এফআইআর নং-৬।
ছনখোলায় নেজাম-ছালেকের সঙ্গে যাওয়া অস্ত্রধারীদের মধ্যে ফরহাদ ছিলেন অন্যতম এবং তিনি ঘটনাস্থল থেকে সিএনজিযোগে পালিয়ে গিয়েছিলেন— এমন গুঞ্জন রয়েছে। গত ৩ মার্চ রাতে সাতকানিয়ার এওচিয়ার ছনখোলায় নেজাম ও ছালেককে ক্ষুব্ধ জনতা ঘেরাও করার পরপরই তাদের অন্তত ৩০ জন সহযোগী ঘটনাস্থল ছেড়ে অপেক্ষমাণ ছয়টি সিএনজিতে করে পালিয়ে যান। এদের মধ্যে ফরহাদ ছাড়াও ছিলেন উত্তর কাঞ্চনার আবদুর রহমান ডিলার বাড়ির বক্কর, সৈয়দ মেম্বার বাড়ির হোছাইন, সিকদার বাড়ির আব্দুল হামিদ, চেয়ারম্যান বাড়ির গিয়াসউদ্দিন খোকন, সাবু, হাজারীখিলের কালা ফারুক, হাজির পাড়ার মোজাম্মেল ও শামসু, আদর্শ গ্রামের আলম ও হাকিম, বকশিরখীলের এরশাদ ও আলমগীর চৌধুরী।
অস্ত্রবাণিজ্যের দুই ‘মধ্যস্থতাকারী’
অস্ত্র বেচাকেনার নেটওয়ার্কে অনেক পুরনো লোক অস্ত্র ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান। এলাকায় ‘গুরুজ’ নামে পরিচিত এই অস্ত্র ব্যবসায়ীর বাড়ি সাতকানিয়া পৌরসভার কুরুত্যাপাড়ায়। তার প্রকাশ্য কোনো পেশা নেই। তবে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে তিনি অস্ত্রব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বছরকয়েক আগে সাতকানিয়া মহিলা কলেজের সামনে থেকে তিনি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার আগেও অস্ত্রমামলায় তিনি একাধিকবার জেলে ছিলেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তার ইসহাকও দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র বেচাকেনায় ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে কাজ করে আসছেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। আবদুল গণির বাসা থেকে পাওয়া লোহাগাড়া থানা লুটের পিস্তলটি এই দুজনের মধ্যস্থতায় কিনে নিয়েছিলেন কাঞ্চনার আবু বক্কর।
অস্ত্র বেচাকেনায় পুলিশের ছায়া: কলরেকর্ডে দরকষাকষি
থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র বেচাকেনায় সম্প্রতি সাতকানিয়ার কাঞ্চনার বাসিন্দা বর্তমানে চাঁদপুর জেলা পুলিশে কর্মরত এক কনস্টেবলের নাম ওঠে আসে। তার কয়েকটি কলরেকর্ডের বিস্তারিতও ওঠে আসে বিভিন্ন মাধ্যমে। অভিযোগ ওঠার পর সেটির সত্যতা যাচাইয়ে কনস্টেবল রিয়াদকে চট্টগ্রামে ডেকে পাঠানো হয় গত শনিবার (১৫ মার্চ)। তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একটি টিম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য পেলেও পরদিনই চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা জানান, সাতকানিয়ায় যে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে সেটি রিয়াদ বিক্রি করেছে— জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পুলিশের অন্য একটি সূত্র বলছে, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রিয়াদ অস্ত্র বেচাকেনার একটি নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত।
পুলিশ আপাতত এটুকু নিশ্চিত হয়েছে, কলরেকর্ডে যে অস্ত্র নিয়ে আলোচনা চলছিল রিয়াদের মাধ্যমে সেটি বিক্রি হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর নেজামের সহযোগী হয়ে ওঠা অস্ত্রব্যবসায়ী বক্কর রিয়াদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সেই সূত্রে বক্করের হয়ে রিয়াদ কমিশন পাওয়ার আশায় একটি ‘টরাস’ পিস্তল বিক্রির জন্য ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করেন। তবে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, নেজামের সঙ্গে রিয়াদের অন্তত একবার সশরীর দেখা হয়েছে। কোতোয়ালী থানা থেকে লুট করা একটি ‘টরাস’ পিস্তল আগে থেকেই ছিল নেজামের হাতে। তিনি নিজের জন্য দ্বিতীয় আরেকটি পিস্তল সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছিলেন।
ওই বৈঠকে রিয়াদের মোবাইলে অস্ত্রের ছবি দেখে নেজাম বলে ওঠেন, ‘এটা তো আমার কাছে অলরেডি একটি আছে।’ এরপরও নেজাম সেটি কিনতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ‘টরাস’ পিস্তলটির দাম সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা হাঁকানো হলে নেজাম জানান, হুবহু একই আগের ‘টরাস’ পিস্তলটি তিনি মাত্র সাড়ে চার লাখ টাকায় কিনেছিলেন। কিন্তু বক্কর ও রিয়াদ কেউ ওই দামে বিক্রি করতে রাজি হননি। এ সময় নেজাম তার কাছে থাকা পিস্তলটি রিয়াদকে দেখান।
পরবর্তীতে কনস্টেবল রিয়াদের সঙ্গে নেজাম অথবা তার সহযোগী ফরহাদের কয়েক দফায় আলাপ হয় ভয়েস রেকর্ডের মাধ্যমে। এমন এক রেকর্ডে কনস্টেবল রিয়াদকে বলতে শোনা যায়, ‘আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল। এটি নিবেন? এটিতে ৩০ পিস গুলি দেওয়া যাবে। পার পিস ৩ হাজার টাকা করে দিতে হবে।’
রিয়াদ বলেন, ‘আপনাকে যেটি নিতে বলছি সেটি আর আমি যেটি ব্যবহার করছি সেইম। এটি আমি র্যাবে যখন গোয়েন্দা শাখায় ছিলাম তখন তুলেছি। আপনার কাছে যে অস্ত্র দিচ্ছি, সেটি আর এটি সেইম। এরকম অস্ত্র সব বাহিনীর কাছে আছে, সরকারি অস্ত্র। এই অস্ত্র সরস। বুঝছেন, আপনি না হলে আপনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে পারেন। এই অস্ত্রের গুলি সহজে পাওয়া যায়।’
রিয়াদ আরও বলেন, ‘এই অস্ত্রের গুলি প্রশাসনের সবার কাছে পাবেন। আমিও দিতে পারব। আমাদের বার্ষিক একটি ফায়ারিং হয়, ওইসময় ফায়ার না করে গুলি আপনার জন্য রেখে দেব। এ ছাড়া আমার অনেক লিংক আছে। ওদের মাধ্যমেও আপনাকে গুলির ব্যবস্থা করে দিতে পারব। আমি বেশি অনুরোধ করছি, কারণ আমার এই মুহূর্তে টাকার দরকার। ১০ হাজার টাকা আপনি আমাকে অতিরিক্ত দেবেন। সাড়ে ৫ লাখ টাকা বরাবর দিতে হবে। ২ লাখ ১০, ২ লাখ ২০ যেসব অস্ত্র ওই সব আমার কাছে নেই। সাড়ে ৫ লাখ টাকা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।’
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নেজামের লাশের পাশ থেকে উদ্ধার হওয়া থানা লুটের অস্ত্র পুলিশ কনস্টেবল রিয়াদের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে— এমন গুজব ছড়িয়ে নেজাম-ছালেকের ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার একটি চেষ্টা ছিল।’ এর নেপথ্যে ওই ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাওয়া জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতার হাত ছিল বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কেউ কেউ।
নেজামের মুঠোয় ছিল পুলিশের ‘টরাস’
নেজামের ব্যবহৃত অস্ত্রটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেটি ছিল ‘টরাস টিএইচ’ মডেলের ৯ মিলিমিটার ক্যালিবারের পিস্তল। ৪.২৭-ইঞ্চি ব্যারেল ও অ্যাডজাস্টেবল টু-ডট রিয়ার সাইট সুবিধার কারণে সেমি-অটোমেটিক অস্ত্রটি দিয়ে নিখুঁত লক্ষ্যে গুলি করা যায়। মাত্র ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের পিস্তলটির সঙ্গে দুটি ম্যাগাজিন থাকায় এতে ১৭-রাউন্ড গুলি রাখা যায়, যা দিয়ে অনেকক্ষণ শুট করা যায়। বিশেষায়িত পিস্তলটি তৈরি হয় ব্রাজিলের সাও পাওলোর কারখানায়।
২০২১ সালের শুরুতে পুলিশ সদস্যদের ‘অপারেশনাল গিয়ার ট্যাকটিক্যাল বেল্ট’ দেওয়া হয়। সেই বেল্টে রাখার জন্য চিরাচরিত চাইনিজ রাইফেলের বদলে দেওয়া হয় ছোট আকারের শক্তিশালী ‘টরাস’ পিস্তল। গত অন্তত চার বছর ধরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশে (সিএমপি) ‘টরাস’ পিস্তলটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কোতোয়ালী থানা থেকে লুট হওয়া নেজামের ব্যবহৃত পিস্তলটির বডি নাম্বার TKU39161, যার বডির ওপরের অংশের এক পাশে TAURUS BP-2017 MTC MADE IN BRAZIL এবং অপরপাশে TH9 9X19 লেখা আছে। অন্যদিকে ৬টি গুলির খোসার পিছনের অংশে ইংরেজিতে NR BP 2020 লেখা আছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মাথায় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় হামলা চালায় কয়েক হাজার লোক। থানার গেট ভেঙে প্রবেশ করে ভেতরে ঢুকে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করা হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়িও। এ সময় ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে দেয়াল টপকে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে সরে পড়েন। কেউ কেউ আবার পুলিশের পোশাক খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যান।
নেজামের মরদেহের পাশ থেকে পিস্তলটি উদ্ধারের পর ৬ মার্চ সাতকানিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসানের দায়ের করা মামলায় নাম উল্লেখ করে মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়। এদের সকলেই নেজাম ও ছালেকের সহযোগী অস্ত্রধারী। আসামিরা হলেন— কাঞ্চনা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কবির আহাম্মদের পুত্র আলমগীর (২০), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তারের পুত্র ফরহাদ (৪০), ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আলমগীরের পুত্র মো. ফারুক প্রকাশ কালা ফারুক, উত্তর কাঞ্চনা দীঘির পাড় এলাকার গুরা মিয়ার পুত্র সাইফুদ্দীন প্রকাশ সাবু এবং এওচিয়া ইউনিয়নের চুড়ামণি এলাকার আব্বাস উদ্দিনের পুত্র সিএনজিচালক হারুন। এছাড়া ১৪-১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
থানা লুটের অস্ত্রে মোটাতাজা অপরাধজগৎ
গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাতকানিয়া এলাকায় ঢুকেছে— এমন সন্দেহের কথা জানা গেছে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে। গণপিটুনিতে নিহত নেজামের ব্যবহৃত পিস্তলের অনুরূপ একই মডেলের আরও পিস্তল নেজামের অনুসারীদের হাতে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে পুলিশ জানতে পেরেছে। নেজাম নিহত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেও থানা থেকে লুট হওয়া অন্তত দুটি ‘টরাস’ পিস্তল বিক্রির জন্য সম্ভাব্য গ্রাহক খুঁজছিলেন তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী— এমন তথ্য জানতে পেরেছে চট্টগ্রাম প্রতিদিন।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলামও বলেছেন, ‘তাদের (নেজাম ও ছালেক) লাশের পাশে যে অস্ত্র ছিল, এটি কোতোয়ালী থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র। সেদিন সেখানে আরও অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছিল। সেগুলোও একই অস্ত্র বলে আমরা জানতে পেরেছি। পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র তাদের কাছে কিভাবে গেল, আমাদের সেটা খুঁজতে হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কোতোয়ালী থানা থেকে অন্যান্য অস্ত্রের পাশাপাশি শুধু ব্রাজিলিয়ান ‘টরাস’ মডেলের পিস্তল লুট হয়েছে ৩৩টি। সেই পিস্তলের বুলেট লুট হয়েছে অন্তত ৬০০টি। এর মধ্যে হাতেগোনা তিন-চারটি পিস্তল উদ্ধার হয়েছে, যার একটি জামায়াতকর্মী নেজামের হাতে ছিল। এছাড়া লোহাগাড়া থানা লুটের বিপুল অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি।
ছনখোলায় এক আতঙ্কের রাত
গত ৩ মার্চ রাত ১০টার দিকে সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা ১ নম্বর ওয়ার্ডে ক্ষুব্ধ জনতা নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে পিটিয়ে মেরে ফেলে। নিহত দুজনই জামায়াতে ইসলামীর কর্মী। ঘটনার সময় তাদের নেতৃত্বে অস্ত্রধারীরা প্রায় শতাধিক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। এতে অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, তারাবি নামাজের পর রাত ৯টার দিকে অন্তত ২০ জন অস্ত্রধারী সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় জামায়াত নেতা নেজাম উদ্দিন এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় যান। মোট নয়টি সিএনজিচালিত ট্যাক্সি ও একটি মোটরসাইকেলে করে তারা সেখানে যান। গাড়িগুলো থেকে নেমে হেঁটে অস্ত্রধারীদের দলটি কাছের একটি জায়গায় অবস্থান নেয়। এলাকাবাসী তাদের তৎপরতা টের পাওয়ার পর স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকে ‘ডাকাত আসছে ডাকাত আসছে’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় বারবার। এর একপর্যায়ে স্থানীয় এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে নেজাম ও তার সহযোগীদের ঘিরে ফেলে। এ সময় নেজামের সহযোগীরা জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এভাবে প্রায় আধঘন্টা ধরে গোলাগুলি চলতে থাকে। স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময় শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়। এ সময় পুরো ছনখোলা এলাকায় অবর্ণনীয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপরও অবস্থা বেগতিক দেখে নেজাম ও তার সহযোগীরা অদূরে রাখা তাদের গাড়িগুলোর দিকে এগোতে থাকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যেই আরও শক্তি সঞ্চয় করে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ এলাকাবাসী লাঠিসোটা ও দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে নেজাম ও তার সহযোগী আবু সালেহসহ আরও কয়েকজনকে ধরে ফেলে। ক্ষুব্ধ জনতার মারধরে নেজাম ও আবু সালেহ ঘটনাস্থলেই মারা যান।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে পলাতক থাকা নেজাম উদ্দিন ও তার সহযোগীরা এলাকায় ফিরে আসেন। এরপর থেকে নেজাম ও তার বাহিনীর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে কাঞ্চনা, এওচিয়া, চরতী, আমিলাইশসহ আশেপাশের এলাকাবাসী অতিষ্ট ছিল। তারা চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হওয়ায় পুলিশও তাদের সমীহ করে চলতো বলে অনেকের অভিযোগ।
এই ঘটনা নিয়ে পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গত তিন মাসে নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক ওই এলাকায় আটবার গিয়েছিল। ঘটনার দিন তারা সাতটি সিএনজি নিয়ে ছনখোলায় যায়। দোকানিদের অস্ত্র প্রদর্শন করে। এর আগে তারা ওই এলাকায় এক স্থানীয় মেম্বারের স্ত্রীকে মারধর করেছিল। এসব নিয়ে স্থানীয়দের মনে ক্ষোভ ছিল, সেখান থেকেই এই ঘটনা ঘটেছে।’
এ ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘বলা হচ্ছে, একটি দলের একজন চেয়ারম্যান এই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন—এমন কিছু আমরা পাইনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা সেখানে ছিল না। বরং একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীদের আমরা অবিরত খুঁজে যাচ্ছি। তাদের সেখানে অবস্থান করার, এমন ঘটনা ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই।’
সিপি