আবার রক্তাক্ত রাউজান: গুলির মুখে গোলাম আকবর, ২০ জন আহত, গাড়িতে আগুন-গুলি
‘হামলার নেপথ্যে গিয়াস কাদের’
চুলচেরা ফারাকে প্রাণে বেঁচে গেলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। রাউজানের সত্তারহাট এলাকায় তার গাড়িবহর ঘিরে মুহুর্মুহু ছররা গুলি, ইটপাটকেল ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা। সড়কে ভাঙচুর, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় একাধিক মোটরসাইকেল ও গাড়ি। এ ঘটনার জন্য বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সমর্থককে দায়ী করা হচ্ছে। ঘটনার মুহূর্তে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া আর চিৎকার—বিকেলে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের গুরুত্বপূর্ণ ওই অংশ যেন রূপ নেয় ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রে। অন্তত ২০ জন আহত হন সংঘর্ষে, যার মধ্যে অনেকেই বিএনপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মী। এদিকে এই ঘটনার পরপরই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।
এই সহিংসতা শুধু একদিনের দ্বন্দ্ব নয়—বরং উত্তর জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দীর্ঘদিনের টানাপড়েন আর রাজনৈতিক দখলদারির জেরে বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে রাউজান। এক বছরে ১৩ খুনের রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে সোমবারের এই হামলা যেন আরও এক অন্ধকার অধ্যায়ের সংযোজন।
গুলির মুখে গোলাম আকবর, গলার পাশ দিয়ে বয়ে যায় মৃত্যু
গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা দাবি করেন, গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করেছে। গোলাম আকবর খোন্দকারকে লক্ষ্য করেই গুলি করা হয়। কিন্তু সেটি গলার পাশ দিয়ে চলে গেছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকালে চট্টগ্রাম–রাঙামাটি সড়কের পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সত্তারহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
আরও আহতদের মধ্যে রয়েছেন রাউজান উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসিম উদ্দিন চৌধুরী, গোলাম আকবর খোন্দকারের ব্যক্তিগত সহকারী অর্জুন কুমার নাথ ও এপিএস আসিকুর রহমান, যুবদল নেতা সাজ্জাদ হোসেন, বিএনপি নেতা আওরঙ্গজেব সম্রাট, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি নাঈম উদ্দিন মিনহাজ, মোহাম্মদ হুমায়ুন। তবে আহত আরও অনেকের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সংঘর্ষের আগুনে পুড়ল দুই পক্ষের সম্পর্ক
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নেতাকর্মীদের বহর নিয়ে উপজেলা বিএনপির প্রয়াত সভাপতির কবর জিয়ারত করতে যান গোলাম আকবর খন্দকার। এদিন আগামী ৯ আগস্ট সমাবেশের প্রস্তুতি হিসেবে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিল গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীদের। গোলাম আকবর তার বহর নিয়ে সত্তারহাট এলাকায় পৌঁছালে সেখানে অবস্থান নেওয়া গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীদের মুখোমুখি হন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। ঘটনার পরপরই গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেখানে পুলিশ এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঘটনাস্থলের কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গোলাম আকবর খোন্দকারের গলায় কাটা দাগ, রক্ত ঝরছে। নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একটি পাজেরো জিপ ভাঙচুরে চুরমার হয়ে গেছে। সড়কে পড়ে আছে পুড়িয়ে দেওয়া কয়েকটি মোটরসাইকেল।
‘আমরা কবর জিয়ারতেও যেতে পারি না’
গোলাম আকবর খোন্দকারদের অনুসারীরা জানান, আওয়ামী সরকারের আমলে গত ১৭ বছর এলাকায় থাকতে পারিনি। এখনও আমরা শান্তিতে থাকতে পারছি না। আমরা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও রাউজান উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কবরস্থানে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই পথে আমাদের ওপর হামলা হয়। আমাদের কবর জিয়ারত করতে যেতে দেওয়া হয়নি।
গোলাম আকবর খোন্দকারের ব্যক্তিগত সহকারী অর্জুন কুমার নাথ জানান, গোলাম আকবর খোন্দকারকে লক্ষ্য করেই গুলি করা হয়। গলার পাশ দিয়ে গুলি চলে গেছে। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
হামলার পর গোলাম আকবর খোন্দকার জানান, আমি আগেই খবর পেয়েছিলাম, তারা হামলা করবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। পরে একটি নোট পেলাম, গিয়াস উদ্দিনের নির্দেশে আজ সারাদিন সত্তরঘাট থেকে মুন্সিঘাটা পর্যন্ত মিছিল করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে তারা আমাকে কনফার্ম করে, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমরা আছি’। তারপর আমরা এসেছি। কিন্তু আমরা যখন সত্তরঘাট ব্রিজ ক্রস করলাম তখন ৫০-৬০ জন লোক ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করল। লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করলো।
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, সত্তারহাট এলাকায় গোলাম আকবর খন্দকার ও তার অনুসারীদের গাড়িবহর নিয়ে যাওয়ার সময় গিয়াস কাদেরের অনুসারীদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত
রাউজানে বিএনপির দুই পক্ষের হামলার ঘটনার পর উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাত ৮টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। শীঘ্রই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে।
২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির গোলাম আকবর খন্দকারকে আহ্বায়ক করে ৪৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম আকবর খন্দকারের ওপর হামলা হওয়ার পর পুরো কমিটি বিলুপ্ত করার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘অভিযুক্তদের বিচারের বদলে কমিটি বিলুপ্ত করে কী বার্তা দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা?’
গিকার পদ স্থগিত
কেন্দ্রীয় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত অপর এক চিঠিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদ স্থগিত ঘোষণা করা হলো। এছাড়া দলের ভেতর সংঘাত, হানাহানি সৃষ্টি করে দলীয় শৃঙ্খলা চরমভাবে লঙ্ঘন করায় বিলুপ্ত উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন, মিরসরাই উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব গাজী নিজাম উদ্দিন, বারইয়ার হাট পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক দিদারুল ইসলাম মিয়াজী, যুবদল নেতা সিরাজুল ইসলাম ও কামাল উদ্দিনকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এক বছরে ১৩ খুন
রাউজানে গত এক বছরে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক আধিপত্যের জেরে ‘টার্গেট কিলিং’। তবে এর মধ্যে ১০টিই রাজনৈতিক বলে মনে করছে পুলিশ। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, এলাকা দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরেই মূলত এই সংঘর্ষগুলো ঘটে। এর মধ্যে অন্তত ৩ শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
সর্বশেষ গত ৬ জুলাই দুপুরে কদলপুর ইউনিয়নের ইশানভট্ট হাটবাজারে দিনদুপুরে অটোরিকশায় করে এসে বোরকা পরা একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে মুহাম্মদ সেলিম নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে।
ডিজে