চট্টগ্রামে এক কলেজছাত্রকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে কোতোয়ালী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) আরমান হোসেন ও এক তরুণীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। বাদী ওই ছাত্রের বাবা মামুন আহমেদ।
ঘটনার পরপরই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ‘থানায় ডেকে মানসিক নির্যাতন, রাতেই যুবকের আত্মহত্যা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সামান্য অভিযোগের ভিত্তিতে ছাত্র ও তার মা-বাবাকে থানায় ডেকে নিয়ে চরম অপমান ও মানসিক নির্যাতন চালান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। সহ্য করতে না পেরে সেদিনই ওই তরুণ আত্মহত্যা করেন।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম বেগম নুসরাত জাহান জিনিয়ার আদালতে এ মামলা দায়ের করা হয়। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।
মামলার তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা আরমান হোসেন বর্তমানে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনার সময় তিনি চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিলেন।
এ ছাড়া নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার এক তরুণীকেও মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ওই ছাত্রের প্রেমিকা ছিলেন।
বাদীর আইনজীবী রিক্তা বড়ুয়া জানান, মানসিক অত্যাচার ও চাঁদা দাবির মাধ্যমে একজন কলেজছাত্রকে আত্মহত্যায় প্রভাবিত করার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। আদালত মামলা গ্রহণ করে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।
বাদী মামুন আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম রাফি (২০) চট্টগ্রাম ইসলামিয়া কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর নিজ বাসায় তিনি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
মামুনের অভিযোগ, রাফি এবং অভিযুক্ত তরুণীর মধ্যে তিন বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে রাফি জানতে পারেন, মেয়েটি একইসঙ্গে আরেকজনের সাথেও সম্পর্ক রাখছেন। বিষয়টি রাফি মেয়েটির বাবাকে জানিয়ে দিলে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর কোতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই জিডিতে অভিযোগ করা হয়, রাফি তার মেয়ের অশ্লীল ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
মামুন দাবি করেন, ‘সামান্য একটি জিডির ভিত্তিতে ২০ ডিসেম্বর আমার ছেলেকে থানায় ডেকে নিয়ে যান পুলিশ ইন্সপেক্টর আরমান হোসেন। রাফির মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে দুজন মিলে বেড়ানোর ২-৩টি স্বাভাবিক ছবি ছাড়া আর কিছুই পাননি তিনি। এরপর আমাকে ফোন করে দুই লাখ টাকা নিয়ে থানায় আসার জন্য বলেন। না হলে রাফিকে মাদক ও অস্ত্র মামলায় চালান দেওয়ার হুমকি দেন।’
মামুন আরও বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী থানায় যাওয়ার পর তিনি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। আমার স্ত্রীকে বলেন, তার আকাম-কুকামের জন্য এমন ছেলের জন্ম হয়েছে। আমার ছেলেকে বারবার কুলাঙ্গার ডেকে শাসান। সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে আমাদের তিনজনকে থানায় আটকে রেখে মানসিক অত্যাচার চালান।’
মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, দুই লাখ টাকা ২৪ ডিসেম্বর পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং নগদ ৫ হাজার টাকা দেওয়ার পর তারা তিনজন রাত ১০টার দিকে থানা থেকে বাড়ি ফেরার অনুমতি পান। তবে রাফির মোবাইল ফোন জব্দ করে রাখা হয়।
বাদীর দাবি, বাসায় ফেরার পর রাফি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। দণ্ডবিধির ৩০৬ (আত্মহত্যায় প্ররোচনা), ৩৮৫ (প্রতারণাপূর্বক সম্পত্তি দাবি) ও ৩৪ (সাধারণ অভিপ্রায়) ধারায় এ মামলা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা আরমান হোসেনের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘ওই ছেলের সঙ্গে এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক হওয়ায় ছেলেটি তাকে হুমকি দেয় যে, তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও আত্মীয়স্বজন ও বরপক্ষের কাছে পৌঁছে দেবে। ফেসবুকে ছড়িয়ে দেবে বলেও হুমকি দেয়। তখন মেয়েটির বাবা থানায় জিডি করেন। পরে আদালতের নির্দেশে আমি জিডিমূলে ওই ছেলে এবং তার অভিভাবককে থানায় ডেকে আনি। তারা বিকেল ৫টার দিকে এসেছিলেন। বিধি মোতাবেক জিজ্ঞাসাবাদ করি এবং ছেলেটির মোবাইল জব্দ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তারা তিনজন থানা থেকে চলে যান। রাত ১১টার দিকে শুনি ওই ছেলে আত্মহত্যা করেছে।’
এ বিষয়ে খুলশী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলাও করেন তার বাবা। সেখানে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। এখন দেড় বছর পর এসে চাঁদা দাবি কিংবা মানসিক নির্যাতনের যেসব অভিযোগ করছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
তখন তারা যা বলেছিলেন
ঘটনার পরপরই ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ‘থানায় ডেকে মানসিক নির্যাতন, রাতেই যুবকের আত্মহত্যা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পুলিশের তখন দাবি করে, মেয়েটির পরিবার গত ৯ ডিসেম্বর কোতোয়ালী থানায় রাফির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানায়। আদালতের নির্দেশে সেই অভিযোগের তদন্ত করতে থানায় ডাকা হয় রাফিকে। কিন্তু এসব ঘটনার কিছুই জানতেন না তার বাবা-মা।
কোতোয়ালী থানার পুলিশ দাবি ওই সময় করে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা ‘স্বীকার’ করেন রাফি। এমনকি তার মোবাইল ফোনে কয়েকটি অন্তরঙ্গ ছবিও খুঁজে পান পরিদর্শক (তদন্ত) আরমান হোসেন। এমন ঘটনায় ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ক্ষমা চান রাফির মা-বাবা। এক পর্যায়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তার পা ধরে কান্নাকাটি করার মতো ঘটনাও ঘটে।
ওই সময় কোতোয়ালী থানার ওসি-তদন্ত আরমান হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ছেলেটির বাবা-মাকে বলি, পা ধরে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না, যদি ছেলেকে বিপদমুক্ত করতে চান তাহলে মেয়েটির পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চান। তারা যদি অভিযোগটি তুলে নেন, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর থানা থেকে বের হয়ে নিজ ঘরে গিয়ে অপমানে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে আত্মহনন করেন রাফি।’
তবে রাফির বাবা সিএনজিচালক মো. মামুন পুলিশের এই দাবিকে মিথ্যা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাফিকে এই অভিযোগে হাজতে চালান করে দেবে—এমন ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি-তদন্ত আরমান। এ সময় আমার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে জানালে সেই টাকাগুলো ওসি-তদন্ত আরমান বাথরুমে রেখে আসার নির্দেশ দেন। বাকি ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া থানায় থাকাকালীন রাফিকে মানসিক নির্যাতন করা হয়।’
পুলিশের মানসিক নির্যাতনে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ছেলের আত্মহত্যার ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেবেন কিনা— এমন প্রশ্নে নিহতের বাবা মো. মামুন তখন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ওদের সঙ্গে তো পারবো না। ছেলে তো হারাইছি, আর কিছু করতে গেলে ওরা (পুলিশ) বিপদে ফেলবে আমাদের।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ওসি-তদন্ত আরমান হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ওই সময় বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো মিথ্যা যুক্তি আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি রাফির মা-বাবাকে থানায় ডেকে পাঠাইনি, রাফিই নিজের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাদের থানায় এনেছে। এছাড়া রাফিকে আমি হাজতে পাঠাবো যদি টাকা না দেয়, কিন্তু জিডিমূলে তো কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না। আমি তো প্রথমবারই এই অভিযোগের তদন্তের স্বার্থে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য থানায় ডেকেছি।’
চাঁদা দাবির বিষয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘এগুলো জাস্ট কথার কথা, আমি কোনো ধরনের টাকা দাবি ও মানসিক নির্যাতন করিনি। আপনারা চাইলে আমার রুমের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে পারেন। কাউকে মানসিক নির্যাতন করলে তো সেই চিত্র ভিডিও দেখে হলেও কিছুটা বুঝতে পারবেন।’