চট্টগ্রামে সাবেক কাউন্সিলরকে না পেয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আড়ালে অন্য নাটক

এজাহারভুক্ত আসামি না হয়েও গ্রেপ্তার

চট্টগ্রামের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল আলম জসিমকে না পেয়ে তার ক্যান্সার আক্রান্ত অসুস্থ স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটি ঘটনায় দায়ের হওয়ার মামলায় জসিমের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ওই মামলার ৮৩ জন আসামির মধ্যে তিনি ছাড়া একজনও মহিলা নেই। এজাহারভুক্ত আসামি না হয়েও তাসলিমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে তার দেবরকে চট্টগ্রাম আদালত থেকে গ্রেপ্তারের পর সন্ধ্যা থেকে জসিমের খোঁজে একটি ভবনজুড়ে চলে তাণ্ডব।

সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ একে খান এলাকার বাসা থেকে আকবরশাহ থানা পুলিশের একটি দল জসিমের স্ত্রী তাসলিমা বেগমকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে ডবলমুরিং থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

‘আসামিকে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন’

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যজিস্ট্রেট আদালতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের স্ত্রী তাসলিমা বেগমকে সোপর্দের সময় দেওয়া আবেদনে আকবরশাহ থানার এসআই শাহীনুর আলম লিখেছেন, ‘তদন্তকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি উপরোক্ত তদন্তে প্রাপ্ত সন্দিগ্ধ আসামী সূত্রে বর্ণিত মামলার ঘটনার সহিত জড়িত রহিয়াছে। প্রাথমিক তদন্তে উক্ত আসামি মামলার ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে জেল হাজতে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন। আসামী জামিনে মুক্তি পাইলে পলাতক হইয়া মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটিবে। অতএব, মহোদয় মামলা তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত আসামীকে জেল হাজতে আটক রাখিতে মর্জি হয়।’

যে মামলায় সাবেক কাউন্সিলর জসিমের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, সেই মামলার বাদি এক সিএনজিচালক। গত বছরের ৫ আগস্ট জনতার আনন্দ মিছিলে বাদি সিএনজিচালক নিজে শরিক হন— এমন দাবি করে মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘৫ আগস্ট একটি আনন্দ মিছিল ডবলমুরিংয়ের ঈদগা থেকে দেওয়ানহাট যাওয়ার সময় মনসুরাবাদ পুলিশ লাইনের সামনে পাকা রাস্তার ওপর এলে আসামিরা অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে বাদীদের আনন্দ মিছিলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে বাদীর ডান হাতের বাহুর সামনে দিয়ে গুলি লেগে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হয়।’

ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছেন বহুদিন ধরে

৪২ বছর বয়সী তাসলিমা বেগমের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাসলিমা দীর্ঘদিন ধরে ব্রেস্ট ক্যান্সার টাইপ-টুতে আক্রান্ত। তিনি এর আগে ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো ক্যান্সার সেন্টারে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেডিওথেরাপিও চলে তার। বর্তমানে তিনি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ডা. রশীদুন নবীর কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ক্যান্সারের জন্য তিনি বর্তমানে ‘জোলাডেক্স’ কেমোথেরাপির অষ্টম ডোজ শেষ করে নবম ডোজ নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

তাসলিমার এক স্বজন জানান, তার তিন সন্তানই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এর মধ্যে বড় মেয়ে আরিবার বয়স ১৪, ছোট মেয়ে আইভীর বয়স ৯ এবং একমাত্র ছেলে আরিয়ানের বয়স মাত্র ১২।

গ্রেপ্তারের পর চলে অন্য নাটক

সাবেক কাউন্সিলর জসিম ভবনটিতে নেই— এমনটি নিশ্চিত হয়ে পুলিশ চলে আসতে চেয়েছিল প্রথমে। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক জসিমের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশকে চাপ দিতে থাকে। পরে পরিস্থিতি দেখে পুলিশ নিরাপত্তার কথা ভেবে জসিমের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তখনও তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর পরিকল্পনা পুলিশের ছিল না। কিন্তু জসিমের স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পরপরই স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একাংশ নানা মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন জসিমের স্বজনদের। তবে এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা না হওয়ায় শেষপর্যন্ত ডবলমুরিং থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় জসিমের স্ত্রী তাসলিমাকে।

তাসলিমার অপর এক আত্মীয় জানান, ‘কথিত মামলার অভিযোগে তাসলিমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও নেই। তাছাড়া তাসলিমার দলীয় কোনো পদ-পদবি নেই। এমনকি তিনি কখনও কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ছিলেন, এমন কোনো প্রমাণও নেই।’

এজাহারভুক্ত আসামি না হয়েও তাসলিমাকে কিভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হল— এমন প্রশ্নের জবাবে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তাকে (তাসলিমা বেগম) সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে দেখিয়েছি।’ ৮৩ জন আসামির মধ্যে একজনই মহিলা, এটা কি বিস্ময়কর কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘এটা হতেই পারে। অর্থদাতা হিসেবেও কেউ মামলার আসামি হতে পারে।’

জসিম নেই জেনেও ভবনজুড়ে তাণ্ডব

এর আগে রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ থানার একে খান এলাকায় ১৩ তলা একটি ভবন ঘেরাও করে আকবরশাহ থানার পুলিশ। ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের স্থানীয় একটি দল সেখানে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ জানায়, ভবনটির একটি ফ্ল্যাটে স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল আলম জসিম লুকিয়ে রয়েছেন— এমন তথ্য পেয়ে তারা অভিযান চালাতে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাত ১১টা পর্যন্ত প্রায় ৫ ঘন্টা ধরে ওই ভবনে সাবেক কাউন্সিলর জসিমের ফ্ল্যাটে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার হদিস মেলেনি। পরে পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আরও কয়েকটি ফ্ল্যাটে ঢুকে অভিযান চালায়।

ড্রয়ার খুলে খুলে জসিমের খোঁজ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বলেন, ‘বাড়ি তো নয়ই, কাউন্সিলর জসিম যে এলাকাতেই নেই, সেটা সবাই জানে। স্থানীয় কিছু লোক পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে। কারণ কোনো না কোনোভাবে তার খবর পেয়েছিল জসিমের বাসায় বিপুল টাকা রাখা আছে। আমরা দেখেছি, স্থানীয় লোকগুলো প্রতিটি আলমারি ও ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার খুলে খুলে দেখেছে। জসিমের তো আর ড্রয়ারের ভেতরে লুকিয়ে থাকার কথা নয়।’

স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পাশাপাশি স্থানীয় বিএনপি নেতারাও এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল বলে স্বীকার করে ওই নেতা বলেন, ‘টাকা আছে এমন সন্দেহে ভবনটির তালাবদ্ধ কয়েকটি ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙেও ভেতরে ঢুকে পড়ে অনেকে। পুলিশও ছিল ঘটনাস্থলে।’

এর আগে একটি মামলায় চট্টগ্রাম আদালতের সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে সাবেক কাউন্সিলর জসিমের ভাই আকবর হোসেন খোকনকে গ্রেপ্তার করে আকবরশাহ থানার পুলিশ। শফিকুল ইসলাম খান নামের এক ব্যক্তির দায়ের করা মামলায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন খোকন। সকাল থেকেই আদালতে পুলিশ তাকে অনুসরণ করছিল বলে জানা গেছে।

জসিমের আমলনামা

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম আত্মগোপনে চলে যান। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কেটে রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জসিমকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গাড়িতে ঢিল ছোড়া ও হুমকি দেওয়ার মামলায় ১ নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm