চট্টগ্রাম ওয়াসার ৪০০০ কোটির সুয়ারেজ প্রকল্পে বড় দুর্নীতি, সাবেক এমডির স্বজনপ্রীতি

ওয়াসার আগুন সাজানো ছিল কিনা— উঠেছে প্রশ্ন

চট্টগ্রামের হালিশহরে নির্মিত তিন হাজার ৮০৮ কোটি টাকার সুয়ারেজ প্রকল্প এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে অনেকগুলো ফাটলও খুঁজে পেয়েছে দুদক টিম।

এছাড়া গত ১৫ বছর ধরে এমডির চেয়ারে থাকা প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহর স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, পছন্দের লোকজনকে দরপত্র দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে দুদকের অভিযানে।

বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক সাঈদ মো. এমরানের নেতৃত্বে চার সদস্যের এনফোর্সমেন্ট টিম এ অভিযানে পরিাচলনা করে।

দুদক জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর হালিশহরের চৌচালা ও মধ্যম হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায় সুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ একনেক থেকে অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পের কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি তাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৮ শত ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে সুয়ারেজ প্রকল্প।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বাগিয়ে নেন ওয়াসার চেয়ারম্যান পদ। পরে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ড গঠনের পর চেয়ারম্যান পদের চেয়ে ক্ষমতাশালী করা হয় এমডির পদ। তাই চেয়ারম্যান পদ বাদ দিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেই আসীন হন ফজলুল্লাহ। সেই থেকে আট দফা মেয়াদ বাড়িয়ে গত ১৫ বছর ধরে স্বপদে বহাল ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির পদ থেকে তাকে অপসারণ করে সরকার।

এদিকে অভিযান শেষে দুদক কর্মকর্তা সাঈদ মো. এমরান বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ ছিল—হালিশহরে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখানে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে অনিয়ম অর্থাৎ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা সকালে (বৃহস্পতিবার) ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে অনেকগুলো ফাটল দেখতে পেয়েছি। এই ফাটল দেখার পরে এখানে এসেছি এবং প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। প্ল্যান্টে ফাটলের বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানতে চেয়েছি। উনি বলেছেন, প্রকল্পের কনসালটেন্ট ফার্মের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ফাটল সিল করার জন্য যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হবে সেগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে, এখনো রিপোর্ট পাননি। রিপোর্টে রাসায়নিক যথাযথ পাওয়া গেলে ফাটলগুলো সিল করা হবে।

সাঈদ মো. এমরান বলেন, অনিয়মের ফাইলগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তকর থেকে সংগ্রহ করেছি। যাচাইবাচাই করে কমিশন বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। কমিশনের সিদ্ধান্তে পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আছে জানিয়ে সাঈদ মো. এমরান বলেন, সাবেক এমডি দীর্ঘ ১৫ বছর দায়িত্বে ছিলেন। বিশেষ করে ২০২০ সালে ওয়াসা ভবনের তৃতীয় তলায় একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সাজানো ছিল—এমন অভিযোগও এসেছে। যেখানে অনেকগুলো নথি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গায়েব করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছি এ বিষয়ে। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের দেওয়া হয়েছে। এটি আমরা বিস্তারিত স্টাডি করে বলতে পারবো।

সাবেক এমডি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এখানে লোকবল নিয়োগ দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ওনার (একেএম ফজলুল্লাহ) শেষ ৬ মাসে যে নিয়োগ বা বদলিগুলো হয়েছে—এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চেয়েছি। সচিব মহোদয় এগুলো দেওয়ার কথা বলেছেন। সেই রেকর্ডপত্র পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না জানতে পারবো। এখানকার ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদ সাহেবের কাছে একটা তথ্য পেয়েছি। সেটা হচ্ছে, একটা সুয়ারেজ প্রকল্প ছিল। সেই প্রকল্পে সাবেক এমডি সাহেবের ভাগিনা সরোয়ার জাহানের স্ত্রীকে যুক্ত করা হয়েছে। এই প্রজেক্টের যিনি পরিচালক এবং নির্বাহী প্রকৌশলী আছেন, অভিযোগ ছিল জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যারা জুনিয়র ছিল তাদেরকে পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক করা হয়েছে। আমরা সচিব মহোদয়ের কাছে জেষ্ঠ্যতার তালিকা চেয়েছি। এটা বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে আমরা বলতে পারব। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদন্নোতি দেওয়া হয়েছে কি-না।’

কী কী অনিয়ম পেয়েছেন জানতে চাইলে সাঈদ মো. ইমরান বলেন, ‘কিছুটা তো অনিয়ম অবশ্যই আছে। এই যেমন আমরা নিয়োগ সংক্রান্ত একটি তথ্য পেলাম ওনাদের একজন কর্মকর্তার কাছে। আরও কয়েকজন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এটা আসলে রেকর্ডপত্র যাচাই করে বলতে পারবো। অনিয়ম হলে আমরা যথাযথ নিয়মে ব্যবস্থা নেব।’

আইএমই/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm