শেষ মুহূর্তে মাহে রমজানের প্রস্তুতি যেমন হওয়া উচিত

পবিত্র রমজানের রোজা পালন এবং ইবাদত-বন্দেগির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের মাস হলো শাবান। মুয়াজ্জিন যেমন নামাজের জন্য আজান দিয়ে প্রস্তুতি ঘোষণা করে, তেমনি শাবান মাসও মানুষকে রমজানের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানায়। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর দরজায় কড়া নাড়ছে। মাত্র এক মাস বাকি। আর কয়েক দিন পরেই আল্লাহ তাআলার রহমত, বরকত, মাগফিরাত, নাজাত এবং অন্যান্য কল্যাণের মাস রমজানুল মোবারক শুরু হবে। রমজানের অবিরত বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে চাইলে আগে থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কারণ, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভালো প্রস্তুতি মানেই সেই কাজের অর্ধেক সফলতা অর্জিত হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কোনো বান্দা যদি কোনো ভালো কাজ বা আমল যথাযথভাবে ও উত্তম পদ্ধতিতে করে, তবে আল্লাহ তাআলা সেই আমল বা কাজকে পছন্দীয় হিসেবে গ্রহণ করেন।” এ জন্য বরকত ও কল্যাণের এই গুরুত্বপূর্ণ মাস রমজানের আগাম প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। মুমিন মুসলমানের জন্য এই প্রস্তুতি পুরো রমজান জুড়ে রহমত, বরকত, মাগফিরাত, নাজাত এবং যাবতীয় কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত রাখবে।

ইবাদত ও বন্দেগির মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তাঁর দরবারে কান্নাকাটির মাধ্যমে পাপ মোচনের মাস হলো পবিত্র রমজান। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হুঁশিয়ারি হলো, “যে ব্যক্তি রমজান পেল কিন্তু তার পাপ মোচন করতে পারল না, তার ধ্বংস অনিবার্য।” তাই পূর্ববর্তী আলেম ও আল্লাহপ্রেমী বান্দারা রমজানের আগ থেকেই এই মহিমান্বিত মাসের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। এখনো যারা রমজানের জন্য প্রস্তুত হতে পারেনি, তাদের উচিত আজই প্রস্তুতি শুরু করা। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের দুই মাস আগে থেকেই রমজান লাভের দোয়া করতেন। তাই এই পবিত্র মাসে ইবাদত-বন্দেগি, সেহরি, ইফতার, তারাবি, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, ইতিকাফ, তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-ইস্তিগফার, ফিতরা, দান-সদকা ইত্যাদি আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রমজানের প্রস্তুতি:
মহানবী (সা.) প্রধানত পাঁচটি কাজের মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন:

১. দোয়া করা: রমজানের দুই মাস আগ থেকে রমজান লাভের দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।” এই দোয়া ছিল রমজানের জন্য নবীজি (সা.)-এর মানসিক প্রস্তুতি।

২. রোজা রাখা: আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি। তবে শাবান মাসে তিনি বেশি রোজা রাখতেন।”

৩. চাঁদের হিসাব রাখা: আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের চাঁদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন। অন্য কোনো মাসে তিনি এত হিসাব করতেন না। রমজানের চাঁদ দেখে তিনি রোজা রাখতেন। আকাশ মেঘলা থাকলে শাবান মাস ৩০ দিনে গণনা করতেন এবং তারপর রোজা শুরু করতেন।”

৪. তাওবা করা: রমজান মাসকে ফলপ্রসূ করতে তাওবা করে পাপমুক্ত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনরা, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা নুর: ৩১)

৫. ইবাদতের জন্য অবসর বের করা: রমজান ইবাদতের মাস। তাই রমজানের আগেই পারিবারিক, ব্যবসায়িক ও পেশাগত কাজগুলো গুছিয়ে রাখলে রমজানে বেশি সময় ইবাদতে মগ্ন থাকা যায়। রমজানের আগে যে সামান্য সময়টুকু আছে, তা কাজে লাগিয়ে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে অধিক আমল করার তাওফিক দেবেন। আল্লাহ বলেন, “যারা আমার পথে চেষ্টা-সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সুরা আনকাবুত: ৬৯)

সাহাবিদের প্রস্তুতি:
রমজানের সময় নিকটবর্তী হলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ইবাদত-বন্দেগি বৃদ্ধির মাধ্যমে এই পবিত্র মাসের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আনাস (রা.) বলেন, “শাবান মাস শুরু হলে সাহাবিরা কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতেন। তারা সম্পদের জাকাত আদায় করতেন এবং অসহায় ও দুর্বল লোকদের সাহায্য করতেন, যাতে তারা রোজা রাখতে পারে।” রমজান নিকটবর্তী হলে ওমর (রা.) নিম্নোক্ত দোয়াটি বেশি বেশি করতেন: “হে আল্লাহ! আমাদের বেশি দান করুন, আমাদের কম দেবেন না। আমাদের সম্মান দিন, আমাদের লাঞ্ছিত করবেন না। আমাদের দান করুন, আমাদের বঞ্চিত করবেন না। আমাদের অগ্রগামী করুন, আমাদের ওপর অন্য কাউকে অগ্রগামী করবেন না। আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন এবং আমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখুন।”

পরবর্তী যুগের প্রস্তুতি:
সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর পরবর্তী যুগের পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, তাহাজ্জুদ ও তাওবার মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সারি সাকতি (রহ.) বলেন, “বছর হলো একটি গাছ, মাস হলো তার কান্ড, দিনগুলো হলো শাখা-প্রশাখা, সময়গুলো হলো পাতা এবং মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস হলো তার ফল। রজব মাসে গাছটি পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়, শাবানে শাখা-প্রশাখা বের হয় এবং রমজানে তাতে ফল ধরে। মুমিন হলো সেই ফল সংগ্রহকারী।”

বছরজুড়ে রমজানের ভাবনা:
প্রকৃতপক্ষে পূর্বসূরিরা সারা বছরই রমজানের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, “পূর্বসূরিদের কাছ থেকে একদল মানুষ একটি দাসী কিনল। রমজানের সময় নিকটবর্তী হলে দাসী তাদের রমজানের প্রস্তুতি নিতে দেখল। তারা খাদ্য ইত্যাদি প্রস্তুত করছিল। দাসী তাদের বিষয়টি জানতে চাইলে তারা বলল, ‘আমরা রমজানের রোজার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ দাসী বলল, ‘তোমরা রমজান ছাড়া রোজা রাখো না। আমি এমন একদল মানুষের কাছে ছিলাম, যাদের কাছে পুরো বছরই রমজানতুল্য ছিল। সুতরাং আমাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।'”

তাহাজ্জুদ আদায় করা:
রমজান তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের মোক্ষম সময়। সেহরিতে উঠে আমরা সবাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা বছর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। রমজানের শেষ দিকে তিনি তাহাজ্জুদের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতেন এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন। হজরত আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান (রহ.) থেকে বর্ণিত।

রমজানের করণীয়:
যেহেতু রমজান মাস হেদায়েত লাভের মাস, আল্লাহ তাআলার রহমত লাভের মাস, মাগফিরাত লাভের মাস এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতের মাস, তাই শাবান মাসে গৃহীত প্রস্তুতির মাধ্যমে রমজানের রোজা পালন এবং নফল ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা উচিত। পবিত্র রমজান মাস বছরের বাকি এগারো মাসের চেয়ে অধিক মর্যাদাশীল ও বরকতপূর্ণ। রমজানের ফজিলত লাভে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা মুসলমানের জন্য আবশ্যক কর্তব্য। কারণ আল্লাহ তাআলা পুরো রমজান মাস রোজা পালন করাকে বান্দার জন্য ফরজ করেছেন। এ মাসেই তিনি মানুষের জন্য সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল করেছেন, যাতে মানুষ হেদায়েত, রহমত, বরকত, মাগফিরাত এবং দুনিয়া ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণ লাভ করতে পারে।

পবিত্র মাহে রমজান এবার আমাদের দ্বারপ্রান্তে সমাগত। মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য, চেতনা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রমজান মাস পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের মাস। হে আল্লাহ! রমজানে মুসলিম উম্মাহকে সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লেখানোর তাওফিক দান করুন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের কাতারে শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন। রমজানের আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। নেক কাজের পরিকল্পনাও একটি নেক কাজ। তাই আসুন রমজানের শুরুতে রমজানকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm