চট্টগ্রাম মেডিকেলে জীবন-মৃত্যুর দামে ডায়ালাইসিস ব্যবসা, চিকিৎসার খরচেই শেষ নিঃশ্বাস!

‘২০ হাজার দিলেও কেন কিনতে হয় সব’— রোগীদের কান্না

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে এসে সর্বশান্ত হয়ে ফিরছেন কিডনি রোগীরা। আবার অনেকে টাকার অভাবে বন্ধ করে দিচ্ছেন চিকিৎসা। এর মধ্যে ‘একিউট রেনাল ফেইলিওর’ (এআরএফ) পর্যায়ের ডায়ালাইসিস রোগীরা ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেয়ে ‘ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর’ (সিআরএফ) রোগীতে পরিণত হচ্ছে।

সপ্তাহে দু’বার এআরএফ রোগীদের ডায়ালাইসিস করতে ২০০ টাকা জমা দিতে হয়। আর সিআরএফ রোগীদের ৬ মাসের ডায়ালাইসিসের জন্য জমা দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এই ২০ হাজার টাকার মধ্যে ডায়ালাইসিস সব উপকরণ দেওয়া কথা থাকলেও মেডিকেলে তা মানা হয় না। উল্টো রোগীকে বহন করতে হয় বাড়তি খরচ। ফলে অনেকে টাকার অভাবে মাঝপথেই চিকিৎসা না নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

তবে মেডিকেল কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্যাথেটার হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

কয়েকজন ডায়ালাইসিস রোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতি পিস ক্যাথেটারের বাজার মূল্য সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়া ডায়ালাইজার, ব্ল্যাড লাইন, ফিস্টুলা নিডল, নরমাল স্যালাইন, ডিসপজিবল সিরিঞ্জ, ফাইভ সিসি, মাইক্রোপোর, স্যালাইন সেট কিনতে হয় রোগীর নিজের টাকায়। সব মিলিয়ে যেখানে খরচ হয় প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিআরএফ পর্যায়ের রোগীগুলো ৬ মাসের জন্য ২০ হাজার টাকা জমা দেxয়ার পরও ডায়ালাইসিস করতে এলে তাদেরই সব কিনতে হয়। এজন্য সিআরএফ রোগীরা নির্ধারিত দিনে ডায়ালাইসিস করতে আসেন না।

এ ধরনের দু’জন রোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা খরচের ভয়ে ডায়ালাইসিসের তারিখ থাকলেও যাচ্ছি না। ২০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার পরও প্রতিবার আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। যা ব্যয় করা আমাদের সম্ভব না।’

আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে এআরএফ পর্যায়ের রোগীদের ডায়লাইসিসের জন্য শুরুতেই কিনতে হয় ক্যাথেটারসহ ১১-১২ হাজার টাকার সরঞ্জাম।

কিডনি চিকিৎসকদের মতে, রোগী এআরএফ পর্যায়ে যায়, যখন কিডনি হঠাৎ করে সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এটি সামান্য ক্ষতি থেকে শুরু করে কিডনি ফেইলর পর্যন্ত গড়ায়।

গত ১০ মে ডায়ালাইসিস চিকিৎসা নিতে কিডনি ওয়ার্ডে ভর্তি হন বোয়ালখালীর বাসিন্দা আবুল হাসেম। প্রথমবার ডায়ালাইসিসের জন্য ১৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে তাকে। আর অ্যালবুনর্ম ২০% ১০০ এমএল ইনজেকশনটি কিনতে হয়েছে ৯ হাজার টাকায়।

আবুল হাসেমের স্ত্রী ইয়াছমিন জানান, স্বামীর চিকিৎসার খরচ কুলাতে পারছি না। চিকিৎসা না করিয়ে স্বামীকে নিয়ে যেতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

সাধারণত কিডনি বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করে এবং তরল ও ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে। যেহেতু কিডনি সঠিকভাবে কাজ করে না, এর ফলে রক্তে বর্জ্য পদার্থ জমা হয় এবং শরীরে তরল ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

সিআরএফ হলো বর্তমানে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ নামে পরিচিত। এটি বলতে কিডনির কার্যকারিতার ক্রমবর্ধমান এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতিকে বোঝায়। এটি গ্লোমেরুলার ফিল্টারেশন রেট (জিএফআর) হ্রাস বা কিডনির ক্ষতি চিহ্নিত করে, যা তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়। তখন আর রক্ত পরিষ্কার হতে পারে না।

১৭ নম্বর কিডনি ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগী আসছেন তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপ পার হয়ে। আর তাদের দরকার পড়ছে ডায়ালাইসিসের। মঙ্গলবার (৬ মে) পর্যন্ত ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হন ১১ জন। তবে ডায়ালাইসিসের জন্য প্রতিদিন রোগী থাকে ৩০ থেকে ৪০ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিডনি ওয়ার্ডে ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা ১৩টি। এর মধ্যে ১টি আইসিইউ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নষ্ট আছে দুটি।

কিডনি ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রেহানা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এআরএফ ডায়ালাইসিসের জন্য ফিমোরাল ক্যাথেটার ও জোগুলান ক্যাথেটার দরকার হয়। কিন্তু এ ক্যাথেটার হাসপাতালে সরবরাহ নেই। তাই রোগীকে এটি বাইরে থেকে কিনতে হয়। সপ্তাহে দুবার এআরএফ পর্যায়ের রোগীদের ডায়ালাইসিস করা হয়। ২০০ টাকা করে জমা দিতে হয় রোগীদের। আর সিআরএফ পর্যায়ের রোগীদের ৬ মাসের ডায়ালাইসিস করার জন্য ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। ডায়ালাইসিস করতে যা যা লাগবে, তা ২০ হাজারের মধ্যে সংযুক্ত থাকার নিয়ম থাকলেও তা হয় না। কিডনি ওয়ার্ডে সিআরএফ ডায়ালাইসিসের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন ৫৩ জন।’

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী মেডিকেল কর্মকর্তা (সংযুক্ত) রুমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগে কি সরবরাহ ছিল, তা আমার জানা নেই। তবে আমরা ডায়ালাইসিসের জন্য প্রয়োজনীয় রিকুয়ারমেন্ট রিকুইজিশন দিয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘চাহিদার ভিত্তিতে ডায়ালাইসিসে ক্যাথেটার ৩০ পিস দেওয়া হবে। সপ্তাহ আগে ব্ল্যাড লাইন ১০টি করে দেওয়া হয়েছে, ডায়ালাইজার ৩০০ পিস দেওয়া হয়েছে। ফিস্টুলা ৫০০ পিস দেওয়া হবে। নরমাল স্যালাইন পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তবে ডিপিএস সরবরাহ নেই।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. বিপ্লব কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বর্তমানে কিডনি রোগীরা ৩য় ও ৪র্থ ধাপ পার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাই বেশিরভাগ রোগীর শুরুতেই ডায়ালাইসিসের দরকার পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘কিডনি রোগ হল অপ্রদাহজনক। ডায়াবেটিকস, প্রেসার, ইত্যাদি কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা বর্তমানে বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না। ডায়াবেটিকস, কিডনি ইনফেকশন, হাইপ্রেসার, জন্মগতভাবে জেনিটিক ডিজিস, প্রস্রাবে ঘন ঘন ইনফেকশন, ব্যথানাশক ওষুধ বেশি সেবনের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।’

ডা. বিপ্লব কুমার বড়ুয়া আরও বলেন, ‘আপনার জিএফআর স্কোর জানা থাকলে ডাক্তার রোগীর কিডনি রোগের পর্যায় জানতে পারবেন। সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রণালী সাজাবেন।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm