মেয়র শাহাদাতের একই কলমে ফেল, প্রমোশন ও বাতিল: সিটি কর্পোরেশনে তিন পর্বের নাটক!
প্রশ্ন উঠেছে অন্য নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো নিয়েও
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ঘটে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত ও রহস্যময় এক পদোন্নতি। সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) পদে এক কর্মকর্তা যেখানে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল, তাকেই আবার দেওয়া হয়েছে প্রমোশন। অবাক করার বিষয়, ফেল করার অফিসিয়াল নথি ও পদোন্নতির আদেশ— এই দুই ফাইলেই ছিল মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের নিজস্ব স্বাক্ষর। এই ঘটনায় বিস্ময় ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে-বাইরে। অভিযোগ উঠেছে তদবির, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের। তবে শেষ পর্যন্ত মেয়রের স্বাক্ষরিত আরেক আদেশেই পদোন্নতির আদেশ বাতিল করা হল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়।

মৌখিক পরীক্ষায় ফেল, তবুও প্রমোশন!
কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মৌখিক পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পরও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুপক চন্দ্র দাশকে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২১ এপ্রিল দেওয়া অফিস আদেশ অনুযায়ী, রুপকসহ আরও তিনজনকে এই পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু রুপকের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম—কারণ তিনি ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফেল করেছিলেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন মোট আটজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মাত্র তিনজন—মু. সরওয়ার আলম খান, জাহাঙ্গীর হোসেন ও ফখরুল ইসলাম। একজন অনুপস্থিত ছিলেন এবং বাকি চারজন ফেল করেন, যাদের একজন রুপক চন্দ্র দাশ।
মৌখিক পরীক্ষায় ২০ নম্বরের মধ্যে পাস নম্বর নির্ধারিত ছিল ১০। রুপক পেয়েছেন মাত্র ৯— যার মধ্যে কারিগরি সদস্যদের দেওয়া ৪ ও অন্যান্য সদস্যদের দেওয়া ৫।
অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০১৯ অনুযায়ী, সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) পদে পদোন্নতির জন্য প্রার্থীর ন্যূনতম ৮ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।
এই নিয়ম উপেক্ষা করে রুপককে প্রমোশন দেওয়াকে অনেকেই ‘বিধিভঙ্গ’ ও ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে দেখছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রুপক মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন—এটা রেকর্ডে আছে। তারপরও তাকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, এর পেছনে মেয়রের পিএস মারুফ ও জিয়ার তদবির ছিল। রুপক ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’
মেয়রের দ্বৈত স্বাক্ষর নিয়ে বড় প্রশ্ন
এদিকে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের স্বাক্ষর নিয়ে। কারণ একদিকে তার স্বাক্ষরে পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে—রুপক ফেল করেছেন। অন্যদিকে প্রমোশনের আদেশেও তার স্বাক্ষর রয়েছে, যেখানে রুপকের নামটিই আছে প্রথমে। এমন দ্বৈত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও মেয়রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে।
স্থানীয় সরকার বিষয়ে অভিজ্ঞ এক বিশ্লেষক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকারি চাকরির নিয়মে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পদোন্নতি দেওয়া যায় না। এখানে নিয়োগ বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। মেয়রের সিদ্ধান্ত তদন্তসাপেক্ষ হওয়া উচিত।’
বাছাই কমিটির অজ্ঞাতে পদোন্নতির আদেশ
রুপকের পদোন্নতির সুপারিশ করা বাছাই কমিটিতে সভাপতিত্ব করেছেন মেয়র শাহাদাত নিজেই। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মো. ফিরোজ মাহমুদ, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম আল মামুন এবং জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার শাহীদ ইশরাক।
তবে অফিস আদেশ চূড়ান্ত করার সময় তিনজন সদস্য—ফিরোজ মাহমুদ, মাসুম আল মামুন ও শাহীদ ইশরাক—কোনো স্বাক্ষর দেননি। তাদের সম্মতি না নিয়েই পদোন্নতির আদেশ চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পদসংখ্যা বনাম পদোন্নতি
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) পদের জন্য অনুমোদিত সংখ্যা ৬টি। বর্তমানে ৩টি পদ শূন্য। কিন্তু ২১ এপ্রিলের আদেশে ৪ জনকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে, যা অনুমোদিত কাঠামোর বিরোধী।
সমালোচনার মুখে পদোন্নতি বাতিল
এদিকে তীব্র সমালোচনার মুখে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সন্ধ্যায় মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের আরেক স্বাক্ষরে উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুপক চন্দ্র দাশের পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে।
রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি শোনার পরপরই আদেশটি বাতিল করা হয়েছে।’
প্রশ্নবিদ্ধ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন—বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পদোন্নতি বাতিল করা হলেও একজন অনুত্তীর্ণ কর্মকর্তা কিভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, তার তদন্ত জরুরি। মেয়রের স্বাক্ষর থাকা বিপরীতধর্মী দুটি নথি প্রশাসনিক স্বচ্ছতাকে কতোটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে? তারা বলছেন, প্রকৌশলী রুপক চন্দ্র দাশের পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে তদবির, রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে সবগুলো নিয়োগ প্রক্রিয়ার নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। তাদের অনেকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত দাবি করেছেন।
সিপি