চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় লাগাম টানা যাচ্ছে না মাদক কারবারের। ৫ হটস্পটে ১০ জন কারবারি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই এলাকা। এর মধ্যে অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করলেও প্রশাসন যেন নির্বিকার। একইসঙ্গে রেলপথ এসব কারবারির জন্য নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া রাতেরবেলা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
সরেজমিন স্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নতুন ও পুরাতন স্টেশন এলাকা যেন মাদক কারবারি ও অপরাধীদের আখড়া। নতুন স্টেশনের ৭ নম্বর বাস পার্কিং স্ট্যান্ড এলাকায় দিনেদুপুর প্রকাশ্যে মাদকসেবন চলছে। কিশোর বয়সীদের আড্ডা বেশি। স্টেশনের প্লাটফর্মে অনেকে ড্যান্ডি (জুতার সলিয়শন গাম) খেয়ে শুয়ে আছেন। ট্রেনের যাত্রীদের চলাচল বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। রাতে প্লাটফর্ম ও স্টেশনের বাইরের এলাকায় দলবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে ভবঘুরে ব্যক্তিরা। কিছু জায়গায় বৈদ্যুতিক বাতি কম না থাকায় যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নিতে ওঁৎ পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা।
মাদকের ৪ হটস্পট
চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকায় মাদকের প্রধান ৪টি হটস্পট রয়েছে। এসব এলাকা থেকে মাদক সরবরাহ করা হয় আশপাশের এলাকায়। এভাবে পার্কিং স্ট্যান্ড, পুরাতন স্টেশন, রেললাইনের আশপাশে গড়ে ওঠা ঝুপড়ি ঘর, বরিশাল কলোনিতে পৌঁছে যায় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ নানান মাদক দ্রব্য।
মাদকের চার হটস্পটের মধ্যে রয়েছে—নতুন স্টেশন, পুরাতন স্টেশন, বিআরটিসি ও মাদারবাড়ি রেলগেট এলাকা। এর মধ্যে নতুন স্টেশনের পার্কিং ও পুরাতন স্টেশনের পার্কিংসহ খালি এলাকাজুড়ে বসে মাদকের হাট। বিআরটিসির ফলমন্ডির পাশের গলি ও রেলগেট এলাকার আশপাশে সন্ধ্যা নামতেই রমরমা হয় মাদকের কেনাবেচা।
নিয়ন্ত্রণে ১০ মাদক কারবারি
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকায় মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ১১ কারবারি।
তারা হলেন—পুরাতন স্টেশনের ৭নং পার্কিং এলাকায় শিখার জামাই খোকন, জামালের বউ (জানি), মরিয়ম, রাজু, সাগর ওরফে চোরা সাগর, মাহিন, স্বপন, জামাই ইব্রাহিম, তারেক, শরিফুল ইসলাম ওরফে ন্যাড়া শরিফ।
এছাড়া তালিকা আছেন আরও চার চিহ্নিত ছিনতাইকারী। তারা হলেন—ফারুক বাবুল, বালুর মাঠের জাহিদ, বিআরটিসির আলতাফ, মুন্না ও কালু।
প্লাটফর্মে চলে মাদক বিক্রি
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) শীর্ষ মাদক কারবারি রাজীব দাশকে মাদক সরবরাহ করতে দেখা গেছে।
সিএমপির পাহাড়তলী, কোতয়ালী, খুলশী, চান্দগাঁও থানায় রাজীবের নামে ৭টি মাদকের মামলা আছে। অথচ প্লাটফর্মে দায়িত্ব পালন করেন আরএনবির সদস্যরা। এছাড়া প্ল্যাটফর্মের অল্প দূরত্বে রয়েছে গভর্নমেন্ট রেল পুলিশের (জিআরপি) কার্যালয়।
আরও জানা গেছে, স্টেশন এলাকায় গাঁজা পাইকারি সাপ্লাই দেন কবির হোসেন ও লোকমান নামে দুই ব্যক্তি।নতুন স্টেশনে হোসেন ও শাহিদা দম্পতি মিলে দিনেরাত ইয়াবা, গাঁজা বিক্রির হাট বসান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝেমধ্যে ঝটিকা অভিযান চালালেও জামিনে বেরিয়ে ফের অপরাধে জড়ায় এসব মাদক ব্যবসায়ী।রাতের বেলা দেখে মনে হয় চট্টগ্রাম রেল স্টেশন যেন মাদক কেনাবেচার হাট।
চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির বিষয় অস্বীকার করে আরএনবির সিআই আমান উল্লাহ আমান বলেন, রাজীব নামে কাউকে চিনি না।
টাকা তোলেন ‘ক্যাশিয়ার’
এসব এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা পাইকারিভাবে মাদক সরবরাহ করেন। এদের হয়ে ছোট কারবারিদের কাছ থেকে টাকা তোলার কাজ করেন জুয়েল ওরফে ছোট জুয়েল। অভিযোগ রয়েছে, অঘোষিত এ ‘ক্যাশিয়ার’ মাদকের টাকায় ম্যানেজ করেন আরএনবি, থানা ও রেল পুলিশের অসাধু সদস্যদের।
জুয়েল মূলত মাদক কারবারি হোসেনের লোক হলেও অন্যদের ‘হিসাবরক্ষকও’ তিনি। কোন কোন কারবারির কাছে কতটুকু মাদক বিক্রি হচ্ছে, কত টাকা পাওনা সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের হাতে কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক কেনাবেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
দুই মাসে ১৭ মাদক মামলা
চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানায় দুই মাসে ১৭টি মাদক মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে চালান করা হয়েছে। কিন্তু আদালতে পাঠানো হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের রেলস্টেশন এলাকায় মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ে অপরাধীরা।
গত ২১ জুন বিকাল পৌনে ৬টার দিকে চিনকী আস্তানা রেলওয়ে স্টেশনে থাকা চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের ‘ক’ বগির মাঝামাঝি স্থান থেকে সেলিনা আক্তার ওরফে রিয়া নামে এক মাদক কারবারিকে আটক করা হয়। রিয়ার ডান হাতে থাকা কালো রংয়ের কাপড়ের ব্যাগের ভেতর থেকে ৪টি পোটলা থেকে ৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে পাহাড়তলীর রেলস্টেশন এলাকা থেকে গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে র্যা ব-৭। গ্রেপ্তার দুইজন হলেন— মো. আজিম উদ্দিন (২৩) ও মো. সৌরভ চৌধুরী (২৮)। তাদের হাতে থাকা শপিং ব্যাগ তল্লাশি করে স্কচটেপ মোড়ানো ১০ কেজি এবং ১২২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া গতবছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানা মাদকের মামলা হয়েছে ২৬টিম গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৩ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১২ হাজার ৩৮০ পিস, গাঁজা ৪৪ কেজি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মাদক পাচারের অন্যতম নিরাপদ রুটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কক্সবাজার থেকে সহজেই ট্রেনে করে মাদক চলে আসেন নগরে। এরপর এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এই রুটে লাগেজ স্ক্যানারসহ যাত্রী তল্লাশি ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন কারবারিরা।
চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদ উল্লাহ জানান, গত দুই মাসে ১৭টি মামলা হয়েছে। মাদক মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি রাজীব নামে এক মাদক কারবারিতে ধরতে অভিযান চালানো হলেও তিনি পালিয়ে যান।
ডিজে