চীনে তৈরি, নাম জাপানি: চট্টগ্রামে গাড়ির নকল পার্টস সিন্ডিকেটের নেপথ্যে সাবেক এমপির ভগ্নিপতি
গাড়ির ব্রেকের ভুয়া ব্র্যান্ড!
চকচকে মোড়ক, উজ্জ্বল স্টিকার, আর গায়ে লেখা বিশ্বখ্যাত জাপানি ব্র্যান্ডের নাম—সব দেখে মনে হবে একেবারে আসল পণ্য! অথচ এই ‘নকল পণ্যে’ ভর করে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা সিন্ডিকেট।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সরেজমিন হানা দেন জাপানি ব্র্যান্ড ‘এমকে’র বাংলাদেশের একমাত্র পরিবেশক হোসাইন মোটর্স–এর প্রতিনিধিরা। সেখানেই ফাঁস হয় ভয়াবহ ভুয়া পণ্য বাজারজাতের চক্রটি— যার নেপথ্যে রয়েছেন চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের ভগ্নিপতি এসএম সাইদুল আলম।
৪১৪ কার্টন নকল ব্রেক প্যাড জব্দ
এক সপ্তাহ আগে নগরীর ডবলমুরিংয়ের মিঠাগলির ন্যাশনাল কর্পোরেশন নামের একটি দোকানে হানা দিয়ে ৪১৪ কার্টন নকল ডিস্ক ব্রেক প্যাড জব্দ করেন হোসাইন মোটর্সের ম্যানেজার মো. ফেরদৌস। পণ্যগুলো দেখতে ছিল হুবহু আসল ‘এমকে’ ব্র্যান্ডের মতো—লোগো, হলোগ্রাম, স্টিকার—সবই ঠিকঠাক। অথচ সবই ছিল ভুয়া ও চীনে তৈরি।
কিন্তু সবকিছু ছিল নকল। জাপানের ‘এমকে’ ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে চীন থেকে তৈরি করে আনা হয় এসব পণ্য। জাপানি কোম্পানি ‘এমকে কাশিয়ামা কর্পোরেশনে’র তৈরি ‘ডিস্ক ব্রেক প্যাড’ (ব্র্যান্ড: এমকে) হুবহু নকল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের তিন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে।
থানায় জিডি, প্রভাব খাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা
ঘটনার পর বুধবার (৪ জুন) ডবলমুরিং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয় হোসাইন মোটর্সের পক্ষ থেকে।
থানা সূত্রে জানা গেছে, থানায় জিডি করার পরপরই ৪১৪ কার্টন নকল ‘ডিস্ক ব্রেক প্যাড’ ছাড়িয়ে নিতে আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ একটি মহল তার ভগ্নিপতি সাইদুল ইসলামের পক্ষে তদবির করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা থানা কর্তৃপক্ষের ওপর অবৈধ প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। তবে থানার ওসির দৃঢ় অবস্থানের কারণে অবৈধ প্রভাব কাজে আসেনি। বরং পুলিশের উপস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্তের সুযোগ তৈরি হয়।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মালামালগুলো জিডিমূলে জব্দ করে আমাদের হেফাজতে রেখেছি। আমরা এখন এ ব্যাপারে পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছি।’
চীনা পণ্য, জাপানি নাম—পেছনে সাইদুল
জানা গেছে, এসএম সাইদুল আলম দীর্ঘদিন ধরে চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে মোটর পার্টস আমদানি করে আসছেন। সম্প্রতি তিনি চীন থেকে একটি চালানে ‘এমকে ব্র্যান্ড’ উল্লেখ করে ডিস্ক ব্রেক প্যাড আনেন এবং হোসাইন মোটর্সের নকল লোগো ও হলোগ্রাম সংযোজন করে বাজারজাত শুরু করেন।
হোসাইন মোটর্স বিষয়টি টের পেয়ে সরেজমিন গিয়ে সাইদুলকে নকল পণ্যের কার্টনসহ হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তার স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে পুরো সিন্ডিকেটের নাম।
এ প্রসঙ্গে হোসাইন মোটরসের স্বত্ত্বাধিকারী হাসানুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাইদুল আলম নকল পণ্যের ব্যবসায় রীতিমতো পেশাদার। সাত বছর আগেও তিনি জাপান থেকে আমদানি করা আমাদের ব্র্যান্ড ‘পিস্টন’-এর নকল পণ্য চীন থেকে বানিয়ে এনেছিলেন। ওই সময়ও ধরা পড়ার পর মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এসে মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
হাতেনাতে ধরা, ‘মুচলেকা’ দিয়ে রেহাই!
থানায় করা জিডিতে হোসাইন মোটর্সের ম্যানেজার উল্লেখ করেন, ২৪ এপ্রিল তিনি জানতে পারেন, ডবলমুরিং থানার মিটাগলিস্থ ন্যাশনাল কর্পোরেশন নামের একটি দোকানে ‘এমকে’ ব্র্যান্ডের হুবহু নাম, স্টিকার, মোড়ক, প্যাটার্ন ছাড়াও হোসাইন মোটর্সের লোগোসহ নকল পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
খবর পেয়ে তিনি ওই দোকানে গিয়ে সরেজমিনে নকল পণ্য দেখতে পান। এর এক পর্যায়ে ভুয়া লোগো সংবলিত ব্রেক প্যাডের প্যাকেটসহ এসএম সাইদুল আলমকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। পরবর্তীতে হোসাইন মোটর্সের মালিক হাসানুজ্জামান ঘটনাস্থলে আসার পর অভিযুক্তরা দোষ স্বীকার করে ভবিষ্যতে আর এমন কাজ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন এবং দোকানে মজুদ করা ৪১৪ কার্টন নকল ‘ডিস্ক ব্রেক প্যাড’ প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দেন।
এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়িক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি আপোষনামা স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে এসএম সাইদুল আলম তার অপরাধ স্বীকার করে ভবিষ্যতে এমন প্রতারণা আর করবেন না বলে লিখিত অঙ্গীকার করেন। শর্ত ছিল—তিনি হোসাইন মোটর্সের কোনো পণ্যের মেধাস্বত্ব ভঙ্গ করবেন না বা নকল পণ্য বাজারজাত করবেন না। ওই আপোষনামায় তার পক্ষে জামিনদার হিসেবে স্বাক্ষর করেন চৌধুরী মোটরসের স্বত্বাধিকারী বাসুদেব চৌধুরী ও সেলিম মোটরসের মালিক শাহিদুল আলম চৌধুরী।
জালিয়াতচক্রে যারা
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সাইদুল আলম মূলত এই জালিয়াতচক্রের হোতা। তিনি ডবলমুরিং মীরবাড়ির বাসিন্দা আবদুল আজিমের পুত্র এবং নগরীর আমিরবাগ আবাসিক এলাকার ২ নম্বর রোডের ২২ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও বাঁশখালী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি।
সাইদুলের অপর দুই সহযোগী হলেন— সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশার বাসিন্দা মো. শাহনেওয়াজ ভূট্টো। এমকে ব্র্যান্ডের নকল পণ্যগুলো আমদানি করা হয়েছে তার নামেই। তিনি ডবলমুরিং আসকারবাদ বাই লেইন পিরামিড টাওয়ারের এসএ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী। এছাড়া এই চক্রে রয়েছেন ডবলমুরিং মিটাগলির ন্যাশনাল অটো সাপ্লাইয়ের স্বত্বাধিকারী জমির উদ্দিনও।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত সাইদুল আলম ফোন করা হলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। অপর অভিযুক্ত জমির উদ্দিন ফোন ধরেননি।
কিভাবে ঠকানো হচ্ছিল গ্রাহককে?
ডিস্ক ব্রেক প্যাড এমন একটি নিরাপত্তাজনিত অটোপার্টস যা মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার, ট্রাক—সব ধরনের যানবাহনে ব্যবহৃত হয়। এর মানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকে মানুষের জীবন।
নকল ব্রেক প্যাড ব্যবহারে গাড়ির ব্রেক সিস্টেম অকেজো হয়ে যেতে পারে, যা ঘটাতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। এই প্রতারণা কেবল ব্যবসায়িক জালিয়াতিই নয়, জননিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
সিপি