জামায়াত নেতার বক্তব্যে প্রশাসন–পুলিশের ক্ষুব্ধ বিবৃতি, দলের আলটিমেটামের দুদিন বাকি আর
জামায়াতে ইসলামীর নেতা শাহজাহান চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন— বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। দলের দায়িত্বশীল সম্মেলনে জামায়াত নেতা বলেছিলেন, ‘যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, বসবে, গ্রেপ্তার করবে, মামলা করবে। পুলিশকে আপনার পিছনে পিছনে হাঁটতে হবে। থানার ওসি সকালে আপনার অনুষ্ঠান জেনে নিয়ে আপনাকে প্রটোকল দেবে।’
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবাদ জানায়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এই সংগঠনের পক্ষ থেকে শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। সেখানে জামায়াত নেতার বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে উল্লেখ করা হয় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়।
জামায়াত নেতার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠনটি বলেছে, ‘ভবিষ্যতে সবাইকে এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।’
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পেশাদার, নিরপেক্ষ ও নৈতিক সিভিল সার্ভিসের অংশ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের কাজ রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন করা, আইনানুগ দায়িত্ব পালন করা এবং যেকোনো নির্বাচনে সমান সুযোগ, নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।’ প্রশাসনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল, মতাদর্শ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিবৃতিতে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলে, ‘এটি আমাদের পরিচয়ের মূল ভিত্তি এবং পেশাগত নৈতিকতার মূল উপাদান।’
চৌধুরীকে সাত দিনের আলটিমেটাম জামায়াতের
চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক দলীয় সমাবেশে প্রশাসনকে ‘আন্ডারে নিয়ে আসা’ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর জিইসি কনভেনশন হলে ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলনে’ চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার মাত্র দুদিনের মাথায় সোমবার (২৪ নভেম্বর) জামায়াতে ইসলামী তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে। সেখানে স্পষ্ট জানানো হয়, কেন তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেটির লিখিত জবাব সাত দিনের মধ্যে দিতে হবে; অন্যথায় দলীয় গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
নোটিশে জানানো হয়েছে, সাংগঠনিক ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্নকারী বক্তব্য রাখার জন্য দলীয় পর্যায়ে তাকে আগেও একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল। জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমির শফিকুর রহমান তাকে ডেকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং বক্তব্যের ধরন পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য দেখানো হবে— এমন প্রত্যাশা থাকলেও তার আচরণে কোনো সংশোধন দেখা যায়নি। এছাড়া শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যে কূটনৈতিক মহলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্বাক্ষরিত এই কারণ দর্শাও নোটিশে বলা হয়, গত শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলনে’ আপনি বক্তব্য প্রদান করেছেন যে, ‘নির্বাচন শুধু জনগণ দিয়ে নয় যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেপ্তার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।’ আপনার এই বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। আমরা বক্তব্যটি দেখেছি, যা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও মূল স্পিডকে স্পষ্টভাবে ব্যাহত করেছে।’
কারণ দর্শাও নোটিশে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, প্রশাসন পূর্ণ পেশাদারিত্বের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন, এখানে আমাদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে আপনি এই ধরনের সাংগঠনিক ভাবমর্যাদা ক্ষুন্নকারী ও শৃঙ্খলা বিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। যার ফলে আপনাকে কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এমনকি মুহতারাম আমীরে জামায়াতও আপনাকে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন। এতদসত্ত্বেও আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।’
এতে বলা হয়, ‘এই বক্তব্য প্রকাশের পর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। দেশের কূটনৈতিক মহল থেকেও সরাসরি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। একই সাথে দেশ-বিদেশে আমাদের জনশক্তি এবং সাধারণ জনগণের মাঝেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে সংগঠনের ভাবমর্যাদা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা দলীয় গঠনতন্ত্র, নীতি, আদর্শ, শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণের পরিপন্থী।’
কারণ দর্শাও নোটিশে বলা হয়, ‘সম্মানিত আমীরে জামায়াতের নির্দেশে আপনাকে এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হচ্ছে যে ‘কেন আপনার ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না? তার লিখিত জবাব আগামী ৭ (সাত) দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া গেলে দলীয় গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
পুলিশের বারুদ জবাব
চট্টগ্রামের দলীয় সমাবেশে প্রশাসনকে ‘আন্ডারে নিয়ে আসা’ নিয়ে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যে সরব হয়ে উঠেছে এবার পুলিশ ক্যাডারের শীর্ষ সংগঠনও। সোমবার (২৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক কড়া প্রতিবাদলিপি দিয়ে জানিয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের সাবেক সংসদ সদস্য যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সংগঠনের নজরে আসে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরিত সেই প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, ওই বক্তব্যে পুলিশকে দলীয় নির্দেশে মামলা গ্রহণ, আসামি গ্রেপ্তার ও প্রশাসনকে অধীনস্থ করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বাংলাদেশ পুলিশ সংবিধান ও বিধিবদ্ধ আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। গত ১৭ বছরে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী সদস্যের কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলেও গত ৫ আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করছে। তারা জানায়, পুলিশ এখন কোনো রাজনৈতিক দল বা মতের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কাজ করছে এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে। রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার দিন শেষ হয়েছে এবং পুলিশ বাহিনী এখন কেবল জনগণের কল্যাণ ও জবাবদিহিতার নীতিতে বিশ্বাসী।
সংগঠনটি রাজনৈতিক নেতাদের এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক মন্তব্যকে পুলিশকে হেয়প্রতিপন্ন করার নামান্তর বলে আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।


