‘ডিবি’ সেজে রাতের ডাকাতি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ৪০ দস্যুর হাতে ১০ হাজার খামারি জিম্মি
নতুন খেলায় টার্গেট এবার বাড়িঘরও
রাত গভীর হলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের গ্রামীণ অঞ্চলে শুরু হয় ভয়ানক তাণ্ডব। কখনও খামারে, কখনও ঘরে—একই সংঘবদ্ধ চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছদ্মবেশে গরু চুরি ও সশস্ত্র ডাকাতি চালাচ্ছে। ‘ডিবি পুলিশ’ বা ‘আনসার’ পরিচয়ে এসব ডাকাত এখন গ্রামের মানুষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রামের ১৫ ও কক্সবাজারের ৯ উপজেলাসহ ২৪ উপজেলায় বেড়েছে খামার ও বাড়িঘর ডাকাতির ঘটনা। এতে অন্তত ১০ হাজার কৃষক ও খামারি পড়েছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। প্রশাসনের কাগুজে অভিযান চলছে, তবে বাস্তবে সেই প্রভাব নেই। যদি এখনই কঠোর আইন, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ও প্রশাসনিক সমন্বয় না হয়—দেশীয় খামার খাত পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করেছেন।
গরু চুরি থেকে শুরু এখন বাড়িঘরে হামলা
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারজুড়ে এক নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে। ডাকাত চক্র আগে গরু চুরি করত, এখন একই দল রাতের অন্ধকারে বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে। পুলিশ পরিচয়ে ঢুকে তারা নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ও কাগজপত্র লুট করছে।
১১ অক্টোবর কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুরে মোহাম্মদ মিয়ার বাড়িতে ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে ৮ জন ঢুকে নগদ টাকা ও স্বর্ণ লুট করে।
এর চারদিন পর ১৫ অক্টোবর কেঁওচিয়া ইউনিয়নে হোছাইন মোহাম্মদ এহেসানের বাড়িতে একই কায়দায় ১৮ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও মোবাইল নিয়ে যায় সশস্ত্র দলটি।
দুই ডেরায় বন্দি থাকে চোরাই পশু
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চুরি করা গবাদিপশু দুটি নিরাপদ ডেরায় রাখা হয়—একটি চকরিয়ায়, আরেকটি মিরসরাইয়ে। নির্জন জঙ্গলে থাকা এসব ঘাঁটি থেকে পরবর্তীতে ট্রাকে করে পশুগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচার হয়।
‘চোর’ চক্রের আলোচিত সদস্যরা
স্থানীয় সূত্র জানায়, গরু ডাকাতি ও পাচারে নিয়মিতভাবে জড়িত চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে চকরিয়ার নবী হোছাইন ওরফে নইব্যা চোরা (বর্তমানে জেলে), ভিআইপি চোর তৌহিদ (৩২), মো. নাহিদ (২১), মো. সোহেল (২৬), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), আশরাফুল হাসান (২৪), সাইফুল ইসলাম (২৫), মো. রমজান আলী (২৩), ইমরান হোসেন টিপন (২৫) ও মো. রাজীব (২১)।
আর গরু চুরির সঙ্গে যুক্ত হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত নাম—কাউছার (২০), মাহিম (২১), মো. দিদার (২০), হেলাল (৩০), মো. নুরু (২২), মো. সাইদুল (২৩), গাড়িচালক সেনাম (৩২), মুবিন উদ্দিন (৩২), নবাব মিয়া ও আব্দুল শুক্কুর (৩৪)।
বেশির ভাগ সদস্যের বাড়ি চকরিয়া ও পেকুয়ায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেকেই বারবার গ্রেপ্তার হলেও প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় দ্রুত ছাড়া পেয়ে ফের একই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
সীমান্ত থেকে গরু পাচার, নেতৃত্বে রুস্তম
সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে গরু পাচার হয়ে কক্সবাজারে প্রবেশ করছে। ঈদগড় ইউনিয়নের সদস্য রুস্তম এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি গরুপ্রতি ২২ হাজার টাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে গরু সরবরাহ করেন। অস্ত্রধারী সদস্যরা সীমান্ত থেকে গরু এনে ঈদগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এরপর স্থানীয় কাইয়ুম উদ্দিন গরুপ্রতি ৪ হাজার টাকায় চুক্তি করে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন।
সিন্ডিকেট যেখানে পায় আশ্রয়-প্রশ্রয়
স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। নিয়মিতভাবে তাদের বাড়িতে চোরাই পশুর মাংস সরবরাহ করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক তদন্ত থমকে যায়। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নাম আসে, প্রমাণও থাকে, কিন্তু পেছনের শক্তি শনাক্ত করতে গেলেই চাপ আসে।’
খামার শিল্পে ভয়াবহ আঘাত
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রায় ১০ হাজার খামার রয়েছে, যেখানে গবাদিপশুর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় মোট ৯ হাজার ৭৪২টি ডেইরি খামার রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৬২৫টি নিবন্ধিত। এখানে গবাদিপশুর সংখ্যা ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬২৩টি, দেশী গরু ১৪ লাখ ৮৩ হাজার, শংকর জাতের গরু ৮ লাখ ৯১ হাজার, মহিষ ৪৬ হাজার, ছাগল ৫ লাখ ১৬ হাজার, ভেড়া ৩৯ হাজার এবং ঘোড়া ১৫০টি। শংকর জাতের গাভী ৩ লাখ ২৬ হাজার, বকনা ১ লাখ ৪০ হাজার, ষাড় ১ লাখ ৭৩ হাজার ও বাছুরসহ ৮ লাখ ৯১ হাজার।
কক্সবাজার জেলার ৯ উপজেলায় মোট গবাদিপশু ৪ লাখ ৬০ হাজার, মহিষ ২৫ হাজার, ছাগল ১ লাখ ৫২ হাজার, ভেড়া ১৯ হাজার। ডেইরি খামার ৩৬৯টি, হৃষ্টপুষ্টকরণ গরু ৫ হাজার, মহিষের খামার ২০৩টি, ছাগল ১ হাজার ৩৪৩টি, ভেড়া ১২১টি।
রামু ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘ডেইরি খাত দেশের খাদ্যচাহিদা মেটাচ্ছে, কিন্তু রাতের পর রাত ডাকাতির ঘটনায় খামারগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এখনই সমন্বিত অভিযান দরকার।’
খামারিরা বলছেন—‘রাতে পাহারা না দিলে বাঁচি না’
কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলের কৃষক জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘নিয়মিত গরু-ছাগল চুরি হচ্ছে। খামারিদের সুরক্ষায় রাতভর টহল দরকার।’
মিরসরাইয়ের খামারি সোবহান বলেন, ‘ঋণ নিয়ে গরু পালি, কিন্তু নিরাপত্তা নেই। এভাবে চললে ডেইরি খাত ধসে পড়বে।’
পুলিশের দাবি ‘টহল বাড়ানো হয়েছে’
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, ‘খামারিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহজনক যানবাহনে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার সাইফউদ্দীন শাহীন জানান, ‘গরু চোর চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, কয়েকজন আটকও হয়েছে।’
চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম) ওয়াহিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সকল জেলার পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে মহাসড়কে যেন রাতে টহলবৃদ্ধি করা হয়। ইদানিং গরু চুরি ডাকাতির নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। তারপরও গৃহস্থদের সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।’
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রাং বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবার সাথে সাথেই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এমনকি মহানগরের ঘটে যাওয়া অনেক গরু চুরি ও পুলিশ পরিচয়ে খামারে ডাকাতি মামলাও তদন্ত করছে মহানগর ডিবি। শুধু গরু চুরি বা ডাকাতি নয়, যেকোন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিবি পুলিশ সব সময় সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে।’
হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের চট্টগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার মাসুম সরদার বলেন, ‘গরু চুরি ডাকাতি ঠেকাতে রাতে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের টিম জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহজনক কোন গাড়ি দেখলেই তল্লাশি করা হচ্ছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। খামারিদের রক্ষায় সবাই একযোগে কাজ করলে ভালো কিছু সম্ভব।’
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ
কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘খামারিরা সহজে লিখিত অভিযোগ দিতে চান না, তবুও আমরা সভায় বিষয়টি তুলি।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর জানান, ‘বাহিনীর পোশাক পড়ে ডাকাতি আসলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পুলিশ সক্রিয় থাকলে এসব ঘটনা কমবে।’



